Sunday, August 21, 2016

প্রতিদিনে রুকইয়া ও ঝাড়ফুঁক


প্রতিদিনে রুকইয়া ও ঝাড়ফুঁক

চোখের নজর, কালো যাদু, তাবীজ-কবজ, এক্সিডেন্ট, রোগ-ব্যাধি, জিনের আসর; এমন যেকোন বিপদ-আপদ ও ক্ষয়-ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্যে এই দুয়াগুলো পড়তে হয়। এই দুয়াগুলো ওযু ছাড়া, শুয়ে-বসে, যেকোন অবস্থাতেই পড়া যাবে, এমনকি নারীরা ঋতু অবস্থাতেও পড়তে পারবেন। আকস্মিক কোন ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্যে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় এই দুয়াগুলো পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা উচিত। আল্লাহ আমাদের সকলকে তোওফিক দান করুন, আমিন।
(১) জিনের আসর ও দুষ্ট জিনের ক্ষতি থেকে বাচার জন্য আমলঃ
জিনেরা মানুষের উপর আসর করে মানুষের মন-মেজাজ, চিন্তা ভাবনা এমনকি কাজের উপর অনেক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। অনেক দুষ্ট জিন মানুষের বিশেষ করে মুমিনদের ক্ষতি করে থাকে। একজন সাহাবী রাতের বেলা একাকী সফরে বের হয়েছিলেন, জিনেরা তাঁকে তীর বিদ্ধ করে হত্যা করেছিলো। অন্য এক সাহাবীর ঘরে একটা জিন সাপ হয়ে বসে ছিলো। ঐ সাহাবী যখন তাকে সাপ মনে করে হত্যা করতে যান, তখন ঐ জিন তাকে দংশন করে হত্যা করে ফেলে। জিনের ক্ষতি থেকে বেঁচে থাকার সহজ একটি আমল হচ্ছে প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় একবার করে আয়াতুল কুরসী পড়া। 
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি সকাল বেলা আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে, তাকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জিনদের থেকে রক্ষা করা হবে। আর যে ব্যক্তি সন্ধ্যা বেলা আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে, তাকে সকাল পর্যন্ত জিনদের থেকে রক্ষা করা হবে।” [সহীহ তারগীব ওয়াত-তারতীবঃ হা/৬৬২]
নোটঃ সুরা বাকারার ২৫৫ নাম্বার আয়াতকে “আয়াতুল কুরসী” বলা হয়।
নিয়মিত আয়াতুল কুরসী পড়লে যাদু, চোখের নজর, জিনের ক্ষতি ও অন্যান্য বিপদ-আপদ থেকে রক্ষা করে। আর প্রত্যেক ফরয সালাতের পরে একবার পড়লে মৃত্যুর পরে বিনা হিসেবে জান্নাত।
আবু উমামা রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি প্রত্যেক ফরয সালাতের পর আয়াতুল কুরসী পাঠ করে, মৃত্যু ছাড়া আর কিছুই তাকে জান্নাতে প্রবেশ করা থেকে বিরত রাখতে পারবেনা”। [নাসায়ী, ইবনু হিব্বান, হাদীস সহীহ] 
(২) প্রতিদিন সকাল ও সন্ধ্যায় সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক্ব ও সুরা নাস তিন বার করে পড়া। এখানে ‘সকাল’ অর্থ হচ্ছে ফযর সালাতের পর থেকে যোহর পর্যন্ত যেকোন সময়, আর ‘সন্ধ্যা’ হচ্ছে আসর থেকে নিয়ে মাগরিবের মধ্যবর্তী যেকোন সময়। এর ফযীলত হচ্ছে, এই আমল যেকোন (ক্ষতিকর) জিনিস থেকে নিরাপত্তা দেবে।
আব্দুল্লাহ ইবনে খুবাইব রাদিয়াল্লাহু আ’নহু হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে বললেন, “সকাল-সন্ধ্যায় ‘ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ’ (সুরা ইখলাস) এবং ‘ক্বুল আঊযু বিরাবিবল ফালাক্ব’ (সুরা ফালাক্ব) ও ‘ক্বুল আঊযু বিরাবিবন্নাস’ (সুরা নাস) তিনবার করে পড়। তাহলে যেকোন (ক্ষতিকর) জিনিস থেকে নিরাপত্তার জন্য এই আমল তোমার জন্য যথেষ্ট হবে।” [তিরমিযীঃ ৩৫৭৫, আবু দাউদঃ ৫০৮২, নাসায়ীঃ ৫৪২৮, হাসান সহীহ বলেছেন ইমাম তিরমিযী, শায়খ আলবানী]
পড়ার নিয়মঃ প্রথমে “আ’উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম” পড়ে এরপর “বিসমিল্লাহির-রাহ’মানির রাহীম” পড়ে সুরা ইখলাস, সুরা ফালাক, সুরা নাস; এইভাবে একবার করে পড়ার পরে এই সিরিয়ালে আরো দুইবার রিপিট করতে হবে। প্রত্যেক সুরার পূর্বে শুধু “বিসমিল্লাহির-রাহ’মানির রাহীম” পড়তে হবে।
(৩) দশজন দাস মুক্ত করার সমান সওয়াব ও অনেক বড় ফযীলতের একটা দুয়াঃ
لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللَّهُ وَحْدَهُ لاَ شَرِيكَ لَهُ، لَهُ الْمُلْكُ وَلَهُ الْحَمْدُ يُحْيِي وَيُمِيتُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ
উচ্চারণঃ লা ইলা-হা ইল্লাল্লা-হু ওয়াহ’দাহু, লা শারীকালাহু, লাহুল মুলকু ওয়ালাহুল হা’মদু, ইয়ুহ-য়ী ওয়াইয়ুমীতু, ওয়াহুয়া আ’লা কুল্লি শাই’ইন ক্বাদীর। 
অর্থঃ একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কোনো সত্য মাবূদ নেই, তাঁর কোনো শরীক নেই, রাজত্ব তাঁরই এবং সমস্ত প্রশংসা তাঁর। তিনিই জীবন দান করেন এবং তিনিই মৃত্যু দান করেন। আর তিনি সকল কিছুর উপর ক্ষমতাবান।
এই দুয়া ফযর ও মাগরিবের ফরয নামায পড়ার পর পড়লেঃ
(ক) আল্লাহ তাআ’লা ঐ ব্যক্তির জন্য একদল সশস্ত্র ফেরেশতাদেরকে পাঠাবেন, যারা তাকে সকাল পর্যন্ত যেকোন ক্ষতি হতে পাহারা দিয়ে রাখবেন। 
(খ) তার জন্য দশটি নেকী লিখে দেওয়া হবে। 
(গ) তার আমলনামা থেকে দশটি ধ্বংসাত্মক গুনাহ মুছে দেওয়া হবে। 
(ঘ) দশজন ঈমানদার দাস মুক্ত করার সমান সওয়াব তার আমলনামায় লেখা হবে। 
[সুনানে তিরমিযীঃ ৩৫৩৪, হাদীসটি হাসান সহীহ, দারুস সালাম তাহকীক] 
বিঃদ্রঃ এই ফযীলত পাওয়ার জন্য যদি কোনো অসুবিধা যদি না থাকে তাহলে ফযর ও মাগরিবের ফরয নামায পড়ে সুন্নত নামায পড়ার পূর্বেই এবং জায়নামাযে বসেই দুয়াটা পড়তে হবে, সুন্নতের পরে নয়। আর লক্ষ্য করুন দুয়াটাতে অতিরিক্ত “ইয়ুহ্য়ী ওয়াইয়ূমীতু”, এই কথাটা অতিরিক্ত আছে, এটাসহ পড়তে হবে। 
(৪) হঠাৎ কোন বিপদ-আপদ ও দুর্ঘটনা থেকে নিরাপদ থাকার জন্য আমলঃ 
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি সকালে তিনবার ও সন্ধ্যায় তিনবার এই দুয়া পড়বে, কোনো কিছুই ঐ ব্যক্তির ক্ষতি করতে পারবেনা।”
بِسْمِ اللهِ الَّذِي لاَ يَضُرُّ مَعَ اسْمِهِ شَيْءٌ فِي الأَرْضِ وَلاَ فِي السَّمَاءِ وَهُوَ السَّمِيعُ العَلِيمُ
উচ্চারণঃ বিসমিল্লা-হিল্লাযী লা ইয়াদুররু মা আ’সমিহী শাই’উন ফিল আরদি, ওয়ালা ফিস-সামায়ী, ওয়াহুয়াস সামীউ’ল আ’লীম। (তিন বার)।
বাংলা অর্থঃ আমি সেই আল্লাহর নামে শুরু করছি, যার নামে শুরু করলে আসমান ও যমীনের কোনো কিছুই কোনো ক্ষতি করতে পারেনা। প্রকৃতপক্ষে তিনি সর্বশ্রোতা, মহাজ্ঞানী। (তিনবার)।
[আবু দাউদ, তিরমিযীঃ ৩৩৮৮, ইবনে মাজাহঃ ৩৮৬৯, মুসনাদে আহমাদঃ ৪৪৮। হিসনুল মুসলিম, পৃষ্ঠা ১৩৮। শায়খ আলবানীর মতে হাদীসটি হাসান।]
ঘুমানোর পূর্বে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতী আমলঃ
(৫) আয়াতুল কুরসী পাঠ করা। ঘুমানোর পূর্বে আয়াতুল কুরসী পাঠ করার ফযীলতঃ
(ক) সকাল পর্যন্ত তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন হেফাজতকারী (ফেরেশতা) তাকে নিরাপত্তা দেবে। (খ) শয়তান তার কাছে আসতে পারবেনা।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম একজন সাহাবীকে বলেছিলেন, “যখন তুমি বিছানায় ঘুমুতে যাবে তখন আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার উপর সব সময় একজন হেফাযতকারী নিযুক্ত থাকবে এবং ভোর পর্যন্ত শয়তান তোমার ধারে কাছেও আসতে পারবে না।” [সহীহ বুখারী, খন্ড ৬, অধ্যায় ৬১, হাদিস নং ৫৩০]
[এখানে হাদীসটা আসলে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা আসলে এক জিনের সাথে এক সাহাবীর আশ্চর্যজনক দীর্ঘ একটা ঘটনার ছোট্ট একটা অংশ। সম্পূর্ণ কাহিনীটা জানার জন্য আপনারা রিয়াদুস সালেহীন এর বই ৯, হাদিস নং- ১০২২ থেকে দেখে নিতে পারেন।
(৬) ঘুমানোর পূর্বে সুরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়া। 
ঘুমানোর পূর্বে সুরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত (২৮৫+২৮৬) পড়ার ফযীলতঃ
(ক) রাত জেগে তাহাজ্জুদ সালাত আদায় করার সমান সওয়াব পাওয়া যাবে। 
(খ) বালা-মুসিবত ও যেকোনো ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ঠ হবে।
(গ) জিন ও শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ঠ হবে।
(ঘ) আয়াতগুলো পড়ে শেষ “আমিন” বললে আয়াতগুলোতে যেই দুয়া আছে সেইগুলো আল্লাহ তাআ’লা কবুল করে নেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আ’লাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যে ব্যক্তি রাতের বেলা সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়বে, সেটা তার জন্য যথেষ্ঠ হবে।” [সহীহ বুখারিঃ ৫০১০, সহীহ মুসলিমঃ ৮০৭]
বিখ্যাত হাদীসের গ্রন্থ “রিয়াদুস সালেহীন” এর লেখক ও সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার, ইমাম আন-নববী রাহিমাহুল্লাহ বলেছেন, “এর অর্থ কেউ বলেছেনঃ কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদ সালাতের জন্য যথেষ্ঠ হবে। কেউ বলেছেনঃ শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ঠ হবে। কেউ বলেছেনঃ বালা-মুসিবত থেকে নিরাপত্তা পাওয়া যাবে। তবে সবগুলো অর্থ সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।” [শারহুন নববী আ’লা সহিহ মুসলিমঃ ৬/৩৪০, হাদীস ৮০৭]
সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার, আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদীস, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রাহিমাহুল্লাহ এই অভিমত সমর্থন করে বলেছেন, উপরের সবগুলো অর্থ নেওয়া সঠিক। আল্লাহ ভালো জানেন। প্রথম অর্থটি (তাহাজ্জুদের সমান সওয়াব পাওয়া) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ রাদিয়াল্লাহু আ’নহু থেকে বর্ণিত একটি মারফু হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। [ফাতহুল বারী ৮/৬৭৩, হাদীস ৫০১০]
এ কারণে আলী রাদিয়াল্লাহু আ’নহু বলেছেন “আমার মতে যার সামান্য জ্ঞান-বুদ্ধি আছে, সে এই দুইটি আয়াত পাঠ না করে নিদ্রা যাবে না”। [মানাকিবুস সাহাবা, ইমাম নবী রাহিমাহুল্লাহ এই কথার বর্ণনা সূত্রকে সহীহ বলেছেন, আল-আযকার]