মৃত-ব্যক্তির প্রতি সাওয়াব প্রেরণের মাসনূন পদ্ধতি
মৃত্যু
পরবর্তী জীবনের সফলতা, মুক্তি, শান্তি ও নেয়ামত লাভের ইচ্ছা ও চেষ্টা সকল
ধর্মের অনুসারিগণই করেন। এই জাতীয় সকল কর্ম একান্তই ধর্মীয় ও
বিশ্বাসভিত্তিক। বিভিন্ন জাতির মধ্যে ধর্মহীনতা ও অজ্ঞানতার প্রসারের ফলে এ
বিষয়ে অনেক কুসংস্কার ও উদ্ভট ধারণা বিরাজমান। যেমন, অনেক সমাজে মনে করা
হয়, মৃতের জীবিত আত্মীয়স্বজনের দান, খাদ্য প্রদান বা কিছু অনুষ্ঠান
পালনের উপরে মৃতব্যক্তির পারলৌকিক মুক্তি নির্ভরশীল।
ইসলামে
এ সকল কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করা হয়েছে। ইসলামের শিক্ষা অনুসারে মানুষের
পারলৌকিক মুক্তি, শান্তি ও সফলতা নির্ভর করে তার নিজের কর্মের উপরে।
সৎকর্মশীল মানুষের মৃত্যুর পরে বিশ্বের কোথাও কিছু না করা হলে, এমনকি তাঁর
দেহের সৎকার করা না হলেও তাঁর কিছুই আসে যায় না। অপরদিকে জীবদ্দশায় যিনি
শির্ক, কুফর, ইসলাম বিরোধিতা, ইসলামের বিধিনিষেধের ও ইসলামী কর্ম ও আচরণের
প্রতি অবজ্ঞা, জুলুম, অত্যাচার, অবৈধ উপার্জন, ফাঁকি, ধোঁকা ইত্যাদিতে
লিপ্ত থেকেছেন তার জন্য তার মৃত্যুর পরে বিশ্বের সকল মানুষ একযোগে সকল
প্রকার ‘শ্রাদ্ধ’, অনুষ্ঠান, ‘প্রার্থনা’ ইত্যাদি করলেও তার কোনো লাভ হবে
না।
তবে
যদি কোনো ব্যক্তি বিশুদ্ধ ঈমানসহ ইসলামের ছায়াতলে থেকে সৎকর্ম করে
মৃত্যুবরণ করেন, তাহলে জীবিত ব্যক্তিগণ তাঁর জন্য প্রার্থনা করলে
প্রার্থনার কারণে দয়াময় আল্লাহ তাঁর সাধারণ অপরাধ ক্ষমা করতে পারেন বা
তাকে সাওয়াব ও করুনা দান করতে পারেন। এছাড়া এই ধরনের মানুষের কল্যাণের
উদ্দেশ্যে কোনো জীবিত মানুষ দান বা জনকল্যাণমূলক কর্ম করলে সেই কর্মের
সাওয়াব করুনাময় আল্লাহ উক্ত মৃতব্যক্তিকে প্রদান করতে পারেন। এই ধরনের
কর্মকে সাধারণত আরবিতে ‘‘ঈসালে সাওয়াব’’ ও ফারসিতে ‘‘সাওয়াব রেসানী’’ বলা হয় যার অর্থ: সাওয়াব পৌঁছানো।
তাহলে
আমরা দেখছি যে, মানুষের মুক্তি নির্ভর করে মূলত নিজের কর্মের উপর। তবে
বিশুদ্ধ ঈমানদার সৎ মানুষদের জন্য দু‘আও দান করা যায়। কুরআন কারীমে মৃত
ব্যক্তির জন্য দু‘আ করার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। হাদীস শরীফে মৃত
ব্যক্তির জন্য ক্ষমা প্রার্থনা, দু‘আ ও দান-সদকা করার জন্য নির্দেশ দেওয়া
হয়েছে। তাঁদের উদ্দেশ্যে জীবিত ব্যক্তির এ সকল কর্মের সাওয়াব তাঁরা লাভ
করবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া মৃতের দায়িত্বে হজ্জপালন বাকি থাকলে
তা তাঁর পক্ষ থেকে পালন করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এগুলি
সাধারণ নির্দেশনা ও ফযীলতমূলক হাদীস। এখন আমাদের দেখতে হবে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম এই ফযীলতের কর্মটি
কী-ভাবে পালন করেছেন। অর্থাৎ এই কর্মটির ক্ষেত্রে ‘সুন্নাত’ কী তা জানতে
হবে।
এখানে উল্লেখ্য যে, দু‘আ
বা দান-সদকার জন্য কোনো প্রকার সমাবেশ, অনুষ্ঠান বা দিন তারিখের কোনো
প্রকারের ফযীলত বা গুরুত্ব আছে - সে কথা কোনো হাদীসে কখনো বলা হয় নি।
এছাড়া কুরআন খতম, কালেমা খতম ইত্যাদি ইবাদত পালন করে মৃত ব্যক্তিদের জন্য
সাওয়াব দান করলে তাঁরা এ সকল ইবাদতের সাওয়াব পাবেন বলে কোনো হাদীসে কোনো
প্রকারে বলা হয় নি।
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীদের যুগে কারো ইন্তেকালের পরে
তার জন্য দু‘আ করার উদ্দেশ্যে পরবর্তী সময়ে কখনো কোনোভাবে তাঁরা জমায়েত
হন নি। কারো মৃত্যু হলে নিকটাত্মীয়গণের জন্য তিন দিন শোক প্রকাশের বিধান
রয়েছে ইসলামে। এই তিন দিনে সমাজের মানুষেরা মৃতের আত্মীয়গণকে সমবেদনা
জানাতে ও শোক প্রকাশ করতে তাঁদের বাড়িতে আসতেন। এছাড়া মৃত ব্যক্তির
জানাযার নামাযের ও দাফনের পরে আর কখনো তাঁকে কেন্দ্র করে ৩ দিনে, ৭ দিনে,
৪০ দিনে বা মৃত্যুদিনে বা অন্য কোনো সময়ে মাসিক, বাৎসরিক বা কোনোভাবে তাঁর
কবরের কাছে, অথবা বাড়িতে বা অনুষ্ঠানকারীর বাড়িতে বা অন্য কোথাও
কোনোভাবে তাঁরা কোনো অনুষ্ঠান করেননি বা কোনো জমায়েতও করেন নি।
মৃত
ওলী, প্রিয়জন বা বুজুর্গের জন্য দু‘আ ও ঈসালে সাওয়াবের ক্ষেত্রে তাঁদের
সুন্নাত ছিল ব্যক্তিগতভাবে দু‘আ করা এবং সুযোগ সুবিধা ও আগ্রহ অনুযায়ী
ব্যক্তিগতভাবে তাঁদের জন্য দান-সাদকা ও হজ্ব ওমরা বা কুরবানি করা। সুযোগমত
কোন প্রকারের আনুষ্ঠানিকতা ছাড়া তাঁদের কবর যিয়ারত করে তাঁদেরকে সালাম
দেওয়া ও তাঁদের জন্য দু‘আ করা।
রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর মৃত্যুর পরে প্রায় একশত বৎসরের
মধ্যে খুলাফায়ে রাশেদীন ও সাহাবীগণ একটিবারও তাঁর কুলখানী, ইসালে সাওয়াব,
ওরস ইত্যাদি উপলক্ষ্যে তাঁর ওফাত দিনে বা অন্য কোনো দিনে, কোনো রকম দিন
নির্ধারণ করে বা না-করে, মদীনায় বা অন্য কোথাও কখনোই কোনো অনুষ্ঠান,
সমাবেশ, মাহফিল, খানাপিনা কিছুই করেন নি।
মৃত
বুজুর্গ বা প্রিয়জনদের জন্য দু‘আ করার ও সাওয়াব প্রেরণের আগ্রহ ও
প্রয়োজনীয়তা তাঁদের ছিল। এ বিষয়ের হাদীসগুলি তাঁরা জানতেন। এজন্য
জমায়েত হওয়া, বিভিন্ন দিনে, নিয়মিত বা অনিয়মিত মৃতের কবরে, বাড়িতে বা
অন্য কোথাও কোনো অনুষ্ঠান করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল। কিন্তু কখনই তাঁরা তা
করেন নি। তাঁরা সকল প্রকারের জমায়েত, আনুষ্ঠানিকতা বর্জন করেছেন। কোনো
প্রকারের দিন তারিখ মাস বার পালন-করা বর্জন করেছেন। সকল প্রকারের কুলখানী,
ওরস, জমায়েত বা অনুষ্ঠান তাঁরা বর্জন করেছেন। তাঁরা ব্যক্তিগত ও
অনানুষ্ঠানিক দু‘আ ও দানকেই এ সকল ক্ষেত্রে একমাত্র পদ্ধতি বলে মনে করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে
মৃত বুজুর্গ বা প্রিয়জনের জন্য সদা সর্বদা সুযোগ ও আবেগ অনুসারে দু‘আ
করাই ছিল তাঁদের স্থায়ী ও নিয়মিত সুন্নাত। এছাড়া কোনো কিছুই তাঁরা
নিয়মিত করেন নি। কারো পিতামাতা বা কোনো আপনজন মারা গেলে হয়ত মৃত্যুর পরেই
তাঁদের জন্য কিছু দান করেছেন, জমি ওয়াকফ করেছেন বা অনুরূপ জনকল্যাণমূলক
কোনো কাজ করেছেন। কেউ বা তাঁদের হজ্ব বাকি থাকলে হজ্ব আদায় করে দিয়েছেন।
ঈসালে সাওয়াব বা মৃতের জন্য সাওয়াব প্রেরণের জন্য সর্বদা দু‘আ করাই ছিল
তাঁদের নিয়মিত সুন্নাত। এ ক্ষেত্রে নিম্নের হাদীসসমূহ প্রনিধানযোগ্য।
প্রথমত:
ব্যক্তির মৃত্যুর পরও যে সব আমলের সাওয়াব সে অব্যাহতভাবে পেতে থাকে এবং
জীবিতরাও মৃতের জন্য এ সকল কাজের আঞ্জাম দিতে পারে এ সম্পর্কে হাদীসে
এসেছে –
عَنْ
أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ
قَالَ «إِذَا مَاتَ الْإِنْسَانُ انْقَطَعَ عَنْهُ عَمَلُهُ إِلَّا مِنْ
ثَلَاثَةٍ إِلَّا مِنْ صَدَقَةٍ جَارِيَةٍ أَوْ عِلْمٍ يُنْتَفَعُ بِهِ
أَوْ وَلَدٍ صَالِحٍ يَدْعُو لَهُ»
‘‘আবু
হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন যে, মানুষ যখন মারা যায় তখন তিনটি আমল ব্যতীত তার
সকল আমলই বন্ধ হয়ে যায়।
১. সাদাকায়ে জারিয়া,
২. মানুষ উপকৃত হয় এমন ‘ইলম এবং
৩. নেক সন্তান, যে তার জন্য দু‘আ করে।’’[1]
অপর এক হাদীসে এসেছে –
عَنْ
أَبِي أُمَامَةَ الْبَاهِلِيِّ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللَّه
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ قَالَ «أَرْبَعَةٌ تَجْرِي عَلَيْهِمْ
أُجُورُهُمْ بَعْدَ الْمَوْتِ مُرَابِطٌ فِي سَبِيلِ اللَّهِ وَمَنْ عَمِلَ
عَمَلًا أُجْرِيَ لَهُ مِثْلُ مَا عَمِلَ وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ
فَأَجْرُهَا لَهُ مَا جَرَتْ وَرَجُلٌ تَرَكَ وَلَدًا صَالِحًا فَهُوَ
يَدْعُو لَهُ»
‘‘আবু
উমামাহ আল বাহিলী রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন যে, চারটি বিষয়ের সাওয়াব প্রাপ্তি
মানুষের মৃত্যর পরও অব্যাহত থাকে।
১. আল্লাহর রাস্তায় সীমান্ত প্রহরী,
২. ব্যক্তির এমন (মাসনূন) আমল যা অন্যেরাও অনুসরণ করে,
৩. এমন সাদাকাহ যা সে স্থায়ীভাবে জারী করে দিয়েছে,
৪. এমন নেক সন্তান রেখে যাওয়া যে তার জন্য দু‘আ করে।’’[2]
দ্বিতীয়ত:
সাহাবায়ে কেরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুম তাঁদের মৃত পিতা-মাতার প্রতি সাওয়াব
প্রেরণের জন্য কী ব্যবস্থা প্রহণ করতেন নিম্নের হাদীসসমূহ থেকে আমরা আরো
স্পষ্ট নির্দেশনা পেতে পারি:
عَنْ
أَبِي هُرَيْرَةَ أَنَّ رَجُلًا قَالَ لِلنَّبِيِّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ
وَسَلَّمَ «إِنَّ أَبِي مَاتَ وَتَرَكَ مَالًا وَلَمْ يُوصِ فَهَلْ
يُكَفِّرُ عَنْهُ أَنْ أَتَصَدَّقَ عَنْهُ قَالَ نَعَمْ»
‘‘আবু
হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট জানতে চাইলেন যে, আমার পিতা কিছু
সম্পদ রেখে মারা গেছেন কিন্তু তিনি কোনো ওসীয়ত করে যান নি। আমি কি তাঁর
জন্য কিছু সাদাকাহ করতে পারি; যাতে তাঁর গুনাহের কাফফারা হতে পারে ? তিনি
বললেন, হ্যা পার।’’[3]
অপর এক হাদীসে এসেছে :
عَنْ
سَعْدِ ابْنِ عُبَادَةَ قَالَ قُلْتُ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أُمِّي
مَاتَتْ أَفَأَتَصَدَّقُ عَنْهَا قَالَ «نَعَمْ قُلْتُ فَأَيُّ الصَّدَقَةِ
أَفْضَلُ قَالَ سَقْيُ الْمَاءِ»
‘‘সা‘দ
ইবন ‘উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি বললাম, ইয়া
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমার আম্মা মারা গেছেন। আমি
কি তাঁর জন্য কিছু সাদাকাহ করতে পারি? তিনি বললেন, হ্যাঁ পার। আমি বললাম,
কোন সাদাকাহ উত্তম? তিনি বলরেন, পানি পান করানো (অর্থাৎ কূপ খনন করে
দেয়া)।’’[4]
অপর এক হাদীসে এসেছে :
»
أَنَّ سَعْدَ بْنَ عُبَادَةَ رَضِي اللَّه عَنْه تُوُفِّيَتْ أُمُّهُ
وَهُوَ غَائِبٌ عَنْهَا فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ إِنَّ أُمِّي
تُوُفِّيَتْ وَأَنَا غَائِبٌ عَنْهَا أَيَنْفَعُهَا شَيْءٌ إِنْ
تَصَدَّقْتُ بِهِ عَنْهَا قَالَ نَعَمْ قَالَ فَإِنِّي أُشْهِدُكَ أَنَّ
حَائِطِيَ الْمِخْرَافَ صَدَقَةٌ عَلَيْهَا»
‘‘সা‘দ
ইবন ‘উবাদাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু এর মা তার অনুপস্থিতিতে মারা যান। পরে
তিনি বললেন, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আমার
অনুপস্থিতিতে আম্মা মারা গেছেন। আমি যদি তাঁর জন্য কিছু সাদাকাহ করি তবে কি
তা তাঁর উপকারে আসবে ? তিনি বললেন, হ্যা। তিনি বললেন, আপনি সাক্ষী, আমার
মিখরাফ নামক বাগানটি তাঁর জন্য সাদাকাহ করলাম।’’[5]
তৃতীয়ত: মৃত্যুর পরও পিতা-মাতার প্রতি সন্তানের কিছু দায়িত্বের কথা নিম্নের হাদীসগুলো থেকে জানতে পারি :
عَنْ
عَائِشَةَ رَضِي اللَّه عَنْهَا أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّه
عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ «مَنْ مَاتَ وَعَلَيْهِ صِيَامٌ صَامَ عَنْهُ
وَلِيُّهُ»
‘‘আয়িশা
রাদিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেন, যে ব্যক্তি রোজা আদায় না করে মারা গেল, তার পক্ষ থেকে
তার ওলী (দায়িত্বশীল) সে রোজা আদায় করবে।’’[6]
অপর এক হাদীসে এসেছে :
عَنْ
أَبِي أُسَيْدٍ مَالِكِ بْنِ رَبِيعَةَ قَالَ بَيْنَمَا نَحْنُ عِنْدَ
النَّبِيِّ صَلَّى اللَّه عَلَيْهِ وَسَلَّمَ إِذْ جَاءَهُ رَجُلٌ مِنْ
بَنِي سَلَمَةَ فَقَالَ يَا رَسُولَ اللَّهِ أَبَقِيَ مِنْ بِرِّ أَبَوَيَّ
شَيْءٌ أَبَرُّهُمَا بِهِ مِنْ بَعْدِ مَوْتِهِمَا قَالَ «نَعَمِ
الصَّلَاةُ عَلَيْهِمَا وَالِاسْتِغْفَارُ لَهُمَا وَإِيفَاءٌ
بِعُهُودِهِمَا مِنْ بَعْدِ مَوْتِهِمَا وَإِكْرَامُ صَدِيقِهِمَا وَصِلَةُ
الرَّحِمِ الَّتِي لَا تُوصَلُ إِلَّا بِهِمَا»
‘‘আবু
উসায়দ মালিক ইবন রবী‘আহ রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, একদা
আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে ছিলাম, এমতাবস্থায় বনী
সালামার এক ব্যক্তি এসে বলল, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম আমার পিতা-মাতার মৃত্যুর পর এমন কোন সদাচরণ কি বাকী আছে যা আমি
তাঁদের সাথে করতে পারি ? তিনি বললেন, হ্যা, তাঁদের জন্য দু‘আ ও ক্ষমা
প্রার্থনা করা, তাঁদের মৃত্যুর পর তাঁদের কৃত প্রতিশ্রুতিগুলো পূর্ণ করা,
তাঁদের বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করা এবং সে আত্মীয়গুলো রক্ষা করা, যেগুলো
শুধু তাঁদের বন্ধনের কারনেই রক্ষা করা হয়ে থাকে।’’[7]
অপর এক হাদীসে এসেছে :
عَنِ
الْحَجَّاجِ ْبنِ دِيْنَارٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ اللهِ صَلَّى الله
ُعَلَيْهِ وَسَلَّمَ «أَنَّ مِنَ الْبِرِّ بَعْدَ الْبِرِّ أَنْ تُصَلِّي
عَلَيْهِمَا مَعَ صَلاَتِكَ وَأَنْ تَصُوْمَ عَنْهُمَا مَعَ صِيَامِكَ
وَأَنْ تُصَدِّقَ عَنْهُمَا مَعَ صَدَقَتِكَ
‘‘হাজ্জাজ
ইবন দীনার হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন, (পিতা-মাতার প্রতি জীবিতাবস্থায়) সদাচরণের পর (মৃত্যু
পরবর্তী) সদাচরণ হলো - তোমার নামাযের সাথে তাদের পক্ষ থেকেও নামায পড়া,
রোজার সাথে তাদের পক্ষ থেকেও রোজা রাখা এবং তোমার সাদাকার সাথে তাদের জন্যও
কিছু সাদাকাহ করা।’’[8]
অপর এক হাদীসে এসেছে :
عَنْ عَطَاءَ قَالَ «يُقْضَى عَنِ الْمَيِّتِ َأْرَبعٌ َالْعِتَقُ وَالصَّدَقَةُ وَالْحَجُّ وَالْعُمْرَةُ» .
‘‘আতা (রহ.) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, মৃতের পক্ষ হতে চারটি কাজ করণীয়: গোলাম আযাদ করা, সাদাকাহ করা, হজ্জ করা এবং ওমরা করা।’’[9]
এছাড়াও সাদাকার পুরস্কার সম্পর্কে এক হাদীসে এসেছে :
«ظِلُّ الْمُؤْمِنِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ صَدَقَتُهُ»
‘‘সাদাকাহ কিয়ামতের দিন মু‘মিনের ছায়া হবে।’’[10]
• উপরোক্ত হাদীসসমূহের সারসংক্ষেপ যা দাড়ায় তা হলো :
১.
মৃত্যুর পরও মৃত ব্যক্তি পাঁচটি কাজের সাওয়াব পেতে থাকে। কাজগুলো হলো :
সাদাকায়ে জারিয়া করে যাওয়া, উপকারী ইলম রেখে যাওয়া, এমন নেক সন্তান
রেখে যাওয়া যে তার জন্য দু‘আ করবে, জীবিত থাকাকালে আল্লাহর রাস্তায়
সীমান্ত পাহারা দেয়া এবং মৃত ব্যক্তির এমন (মাসনূন) আমল যা পরবর্তীতে
অন্যরা অনুসরণ করে।
২.
সাহাবায়ে কেরাম তাঁদের পিতা-মাতার মৃত্যুর পর তাঁদের জন্য সাদাকায়ে
জারিয়ার ব্যবস্থা করতেন। যেমন- ফসলের বাগান ওয়াকফ করতেন, পানির কূপ খনন
করে দিতেন ইত্যাদি।
৩. তাঁদের রোজা বাকী থাকলে তাঁদের পক্ষ হতে তাঁরা তা আদায় করতেন।
৪.
তাঁরা তাঁদের জন্য দু‘আ ও ক্ষমা প্রার্থনা করতেন, তাঁদের কৃত
প্রতিশ্রুতিগুলো পূর্ণ করতেন, তাঁদের বন্ধু-বান্ধবদের সম্মান করতেন এবং সে
আত্মীয়গুলোও রক্ষা করতেন, যেগুলো তাঁদের বন্ধনের কারণে সৃষ্টি হয়েছে।
৫.
তাঁরা তাঁদের পক্ষ হতে গোলাম আযাদ করতেন, হজ্জ করা বাকী থাকলে হজ্জ এবং
ওমরা করতেন। এ ছাড়াও তাঁরা তাঁদের জন্য নফল নামায এবং নফল রোজাও করতেন বলে
জানা যায়।
এখন
আমাদের সমাজে মৃতব্যক্তিদের জন্য দু‘আর উদ্দেশ্যে অথবা তাদের জন্য
দান-সদকার সময়ে বিভিন্ন পদ্ধতিতে আমরা জমায়েত হই ও অনুষ্ঠান করি। এ সকল
অনুষ্ঠান নিঃসন্দেহে খেলাফে-সুন্নাত বা সুন্নাত বিরোধী। অবস্থা এমন
পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে যে, কেউ যদি পূর্ণ সুন্নাত অনুযায়ী
অনানুষ্ঠানিকভাবে দান-সাদকা ও দু‘আ করেন তাহলে অনেক মুসলিম তাঁর কর্মকে
খুবই অপছন্দ করবেন। এভাবে তাঁরা ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম -এর সুন্নাতকে’ অপছন্দ করছেন।
• আমাদের
সমাজের মুসলিমগণ কিভাবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর
সুন্নাত অপছন্দ ও অবহেলা করেন তার কিছু নমুনা এখানে আলোচনা করছি :
(১). দু‘আকে অবহেলা করা ও আনুষ্ঠানিকতাকে উত্তম মনে করা :
আমরা
দেখলাম যে, মৃত বুজর্গ বা আপনজনের জন্য ব্যক্তিগতভাবে সর্বদা দু‘আ করাই
ছিল তাঁদের একমাত্র নিয়মিত সুন্নাত। অপরদিকে আমরা অনেক সময় ‘‘দু‘আ’’
করাকে তত গুরুত্ব প্রদান করি না। চিন্তা করি দু‘আতে আর কি হবে, নিজে কিছু
নেক কাজ করে সেই কাজের সাওয়াব তাঁদেরকে প্রদান করতে হবে। চিন্তাটি সঠিক
নয়। মৃত মুসলিমের জন্য অন্য মুসলিমের দু‘আই সবচেয়ে বড় দান। দু‘আর
বিনিময়ে আল্লাহ তাঁদেরকে অফুরন্ত সাওয়াব ও রহমত প্রদান করেন। মৃতদের জন্য
কুরআনে অনেক দু‘আ উল্লেখিত হয়েছে।
এক্ষেত্রে
দু‘আর জন্য তাঁরা কখনো কোনো প্রকার অনুষ্ঠান করেন নি। আমরা অনুষ্ঠানহীন
ব্যক্তিগত দু‘আর কোনো গুরুত্ব আছে বলে মনে করি না। অন্তত ব্যক্তিগত দু‘আর
চেয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু আলেম ও বুজুর্গকে ডেকে মৃতের জন্য দু‘আ করাকে
উত্তম মনে করি। অথচ সাহাবীগণকে দেখুন। সাইয়্যেদুল মুরসালীন রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁদের মধ্যে রয়েছেন। অথচ ২৩ বৎসরের
নবুয়তী জিন্দেগিতে একদিন একজন সাহাবীও এসে বললেন না, হুজুর আমার পিতামাতা
বা কোনো বুজুর্গের জন্য দু‘আর মাজলিস করেছি, আপনি যেয়ে একটু দু‘আ করে
দেবেন। অথবা মসজিদে নববীতেই আজ নামাযের পরে সবাইকে নিয়ে আপনি একটু দু‘আ
করে দেবেন। এরূপ একটি ঘটনাও দেখতে পাবেন না। অনুরূপভাবে পরবর্তী প্রায় ২
শত বৎসরে সাহাবী, তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ীগণের যুগেও এই ধরনের কোনো ঘটনা
দেখা যায় না।
(২) কুরআন খতম, কালেমা খতম ইত্যাদিকে গুরুত্ব প্রদান ও উত্তম ভাবা :
কুরআন
খতম, কালেমা খতম ইত্যাদিকে আমরা দান ও দু‘আর চেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান
করি। অপরদিকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর
সাহাবীগণ কখনো মৃতের জন্য কুরআন খতম, কালেমা খতম ইত্যাদি অনুষ্ঠান করেন নি।
এগুলির সাওয়াব মৃতব্যক্তি পাবেন বলে কোনো হাদীসে বলা হয় নি। তবে, অনেক
আলেম বলেছেন যে, যেহেতু দান, দু‘আ, হজ্ব ইত্যাদির সাওয়াব মৃতব্যক্তি পাবেন
বলে হাদীসে বলা হয়েছে, সেহেতু আমরা আশা করতে পারি যে, কুরআন তিলাওয়াত,
যিকর, তাসবীহ ইত্যাদি ইবাদতের সাওয়াবও তাঁরা পাবেন।
এখানে উল্লেখ্য যে, কুরআন
কারীম পূর্ণ পাঠ করা বা খতম করা একটি মাসনূন ইবাদত হলেও ‘‘কালেমা খতম’’
কোনো মাসনূন ইবাদত নয়। ‘‘কালেমা খতম’’, ‘‘দু‘আ ইউনূস খতম’’, ‘‘খতমে
খাজেগান’’ ইত্যাদি সবই বানোয়াট ‘‘খতম’’। কালেমা বা ‘‘লাইলাহা ইল্লল্লাহ’’
একটি মাসনূন যিকর এবং শ্রেষ্ঠ যিকর। এই যিকর যতবার করা হবে তত বেশি সাওয়াব
পাওয়া যাবে।[11] এক লক্ষ বা সোয়া লক্ষ বার পাঠ করলে বিশেষ কোনো সাওয়াব
আছে বলে মনে করা খেলাফে-সুন্নাত।
অন্য
অনেক আলেম বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দান,
দু‘আ ইত্যাদির কথা বললেন, অথচ কুরআন খতম বা যিকর-তাসবীহ ইত্যাদির সাওয়াব
মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছাবে বলে জানান নি বা উম্মতকে এগুলি পালন করে মৃতদের
জন্য সাওয়াব রেসানী করতে শেখান নি। এখন আন্দাজে এরূপ আশা করলে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর শিক্ষাকে অপূর্ণ বলে দাবি করা হবে।
সর্বাবস্থায়,
আমরা বুঝতে পারছি যে, আমরা যদি মৃত বুজুর্গ বা আপনজনের জন্য দান করি বা
দু‘আ করি তাহলে তাঁরা তার সাওয়াব পাবেন বলে নিশ্চিত; কারণ স্বয়ং
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে তা বলেছেন। আর
কুরআন খতম, কালেমা খতম ইত্যাদির সাওয়াব পাবেন বলে বড়জোর আশা করা যায়।
যে
সকল আলেম কুরআন খতম বা তাসবীহ-তাহলীলের সাওয়াব মৃত ব্যক্তি পেতে পারেন
বলে আশা করেছেন তাঁরা বলেছেন যে, যদি কেউ শরীয়ত-সম্মতভাবে ইখলাসের সাথে
এগুলি পাঠ করে তাহলেই সাওয়াবের আশা করা যায়। আর সে যদি নিজেই এমনভাবে পাঠ
করে যাতে তারই কোনো সাওয়াব হবে না, তাহলে সে আর কী পাঠাবে! এজন্য কোনো
মুসলিম যদি তাঁর মৃত পিতামাতা, স্বজন বা উস্তাদ-বুজুর্গের জন্য মনের ইখলাস ও
আবেগ নিয়ে কুরআন পাঠ করে তিলাওয়াতের সাওয়াব তাঁদেরকে প্রদানের নিয়্যাত
করে, তাহলে হয়ত তাঁরা পেতেও পারেন। কিন্তু কেউ যদি টাকার বিনিময়ে,
খাদ্যের আশায় বা লোক দেখানোভাবে এসকল ইবাদত করে, তাহলে তার তো কোনো
সাওয়াবই হবে না, উপরন্তু সে গোনাহগার হবে। এক্ষেত্রে সাওয়াব পাঠানোর
চিন্তা বাতুলতা।
এখন
আমাদের সমাজের মুসলিমগণের অবস্থা চিন্তা করুন। সকলেই দান ও দু‘আর চেয়ে এ
সকল খতমকে গুরুত্ব বেশি দিচ্ছেন। প্রয়োজনে অনেক টাকাপয়সা খরচ করে এ সকল
খতমের আয়োজন করছেন। কিন্তু তিনি খতম ছাড়া নিঃশর্তভাবে এই টাকাগুলি হাফেজ
বা খতম পাঠকারীদেরকে দিতে রাজি নন। তিনি সকল দিক থেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
কেউ যদি মৃতের ‘‘ঈসালে সাওয়াব’’
বা সাওয়াব প্রেরণের উদ্দেশ্যে কোনো হাফেজ, আলেম, এতিম, বিধবা, দরিদ্র বা
অন্য কাউকে হাদিয়া, সাহায্য বা দান হিসাবে কিছু টাকা দেন, তাহলে হয়ত তা
দান হিসাবে আল্লাহর কাছে গৃহীত হতে পারে ও মৃত ব্যক্তি সাওয়াব পেতে পারেন।
কিন্তু তিনি এদেরকে দিয়ে ‘‘খতমের কাজ’’ আদায় করে এদেরকে পারিশ্রমিক দান করেন। এ ভাবে তিনি:
প্রথমত, একটি খেলাফে-সুন্নাত কাজ করছেন।
দ্বিতীয়ত, দু‘আ ও দানের সুন্নাত পরিত্যাগ করে বা অপছন্দ করে গোনাহগার হচ্ছেন।
তৃতীয়ত, টাকা বা খাদ্যের আশায় যারা খতম পড়ছেন তাঁরা যেহেতু কোনো সাওয়াবই পাচ্ছেন না, সেহেতু মৃতের জন্য কিছু লাভের ক্ষীণতম আশাও নেই।
চতুর্থত,
এভাবে যাদেরকে দিয়ে খতম পড়ালেন তাঁরাও গোনাহগার হলেন। এভাবে সুন্নাত
ছেড়ে সকল দিক থেকেই তিনি ক্ষতিগ্রস্থ হলেন। অথচ তিনি যদি এতকিছু না করে
নিজে দু‘আ করতেন এবং খরচের টাকাগুলি দান করতেন আর সেটার অসিলায় মৃত
ব্যক্তির জন্য দো‘আ করতেন, তাহলে সুন্নাত অনুসারে কর্মের জন্য নিজেও
সাওয়াব পেতেন, আর দু‘আ ও দানের সাওয়াব মৃতব্যক্তি পেতেন।
আমাকে
অনেকে প্রশ্ন করেছেন, আমরা কুরআন পাঠ করতে পারি না বলে কি পিতামাতাকে কিছু
দিতে পারব না? আমি বলেছি, দান করুন তাহলেই তো হলো। কিন্তু তাঁদের তৃপ্তি
হয় না। মনে হয় তারা চিন্তা করেন, হাফেজদেরকে দিয়ে কিছু কুরআন না পড়িয়ে
শুধু শুধু এতগুলি টাকা তাদেরকে দিয়ে কী হবে?
(৩). দানের ক্ষেত্রে সুন্নাত পদ্ধতির চেয়ে আনুষ্ঠানিকতাকে গুরুত্ব প্রদান :
দানের
ক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণের
সুন্নাত হলো অনানুষ্ঠানিক দান। জমি ওয়াকফ, কূপ খনন ইত্যাদি। কিন্তু আমরা
কখনোই এই প্রকার দানে তৃপ্ত হতে পারি না। আপনি যতই বুঝান-না কেন, যত
সুন্নাতের কথাই বলুন-না কেন, মনের চিন্তা একটিই - কিছু একটু না-করলে কিভাবে
হয়! শ্রা্দ্ধ জাতীয় একটা অনুষ্ঠান করাই দরকার। সমাজের মানুষেরও একই কথা :
বাপটা মরে গেল, কিছুই করল না! কিছু অর্থ ‘‘শ্রাদ্ধ’’।
অনেক
মানুষকে বুঝিয়েছি, আপনারা খানাপিনা করানোর টাকা দিয়ে পিতামাতার বা
বুজুর্গের জন্য একটি মসজিদ, মাদ্রাসা, দাতব্য হাসপাতাল, চিকিৎসা কেন্দ্র বা
এতিমখানা তৈরি করুন বা শরীক হোন। খাবার পানি বা সেচের জন্য গভীর বা অগভীর
নলকূপ স্থাপন করে জনগণ বা চাষীদের জন্য ওয়াকফ করুন। না হলে টাকাগুলি কোনো
দরিদ্র, বিধবা, এতিম, কন্যাদায়গ্রস্থ, অসুস্থ বা অনুরূপ কাউকে দান করুন।
এভাবে আপনি সুন্নাতের মধ্যে থাকবেন, আপনি ও আপনার মৃত আপনজন বা ওলী-বুজুর্গ
অফুরন্ত সাওয়াব ও রহমত লাভ করবেন।
কেউ
বুঝতে চান না। কেউ এসকল খাতে কিছু ব্যয় করলেও ‘‘কিছু একটা’’ না করে পারেন
না। অথচ এই ‘‘কিছু’’ বা খানাপিনা শুধু সুন্নাত বিরোধীই নয়, এতে নিয়্যাত,
পরিবেশনা, সামাজিকতা ইত্যাদি করাণে সাওয়াবের চেয়ে গোনাহই বেশি হয়।
সামাজিক আচার কিভাবে আমাদের মনমগজকে কব্জা করেছে এবং এক্ষেত্রে রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণের সুন্নাতকে মেরে ফেলেছে তা
চিন্তা করুন।
(৪). এ সকল কাজের জন্য কোনো দিন বা মৃত্যু দিনকে নির্ধারণ করা :
মৃত
স্বজন বা বুজুর্গের জন্য দু‘আ ও সাওয়াব প্রেরণ অর্থাৎ ঈসালে সাওয়াব বা
সাওয়াব রেসানীর জন্য হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য অমুসলিম সম্প্রদায়ের
অনুকরণে আরেকটি বিষয় আমাদের মধ্যে প্রবেশ করেছে, তা হলো এসকল কাজের জন্য
দিন নির্ধারণ। মৃত্যুর পরে প্রথমত ৩য়, ৭ম, ৪০তম বা এই জাতীয় দিনে
অনুষ্ঠান করা। পরে মৃত্যু দিনে অনুষ্ঠান করা।
আগেই
বলেছি, নেককার বা বদকার, স্বজন বা বুজুর্গ কারো জানাযা ও দাফনের পরে দু‘আ
বা খানাপিনার জন্য কোনো প্রকার অনুষ্ঠান করাই সুন্নাত বিরোধী কাজ। আর এ সকল
অনুষ্ঠানের জন্য এভাবে দিন নির্ধারণ অতিরিক্ত একধাপ সুন্নাত বিরোধিতা। কুলখানী, দু‘আর মাহফিল, খতম, ঈসালে সাওয়াব, সাওয়াব রেসানী, ওরস ইত্যাদি যে নামেই তা করা হোক সবই সুন্নাত বিরোধী কর্ম। এগুলি করার অর্থ হলো এ সকল বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণের সুন্নাতকে অপছন্দ করা।
(৫). সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী রহ. এর নসীহত :
সমাজের
অপ্রতিরোধ্য চাপের কাছে নতি স্বীকার করে উপরের সকল খেলাফে-সুন্নাত কর্মকে
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, বিভিন্ন ওজরখাহি করে, পূর্বে আলোচিত বিভিন্ন প্রকারে
অপ্রাসঙ্গিক আয়াত ও হাদীসকে ‘‘অকাট্য দলিল’’ হিসাবে পেশ করে ‘‘জায়েয’’
বলেছেন কেউ কেউ। তবে কেউ বলেন নি যে, এগুলি সুন্নাত বা রাসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণ কখনো এগুলি করেছেন।
অপরদিকে
অনেক আলেম সমাজের কাছে নতি স্বীকার করতে চান নি। তাঁরা চেষ্টা করেছেন যেন
আমাদের সমাজ অন্য সকল বিষয়ের মতো এ বিষয়েও অবিকল সুন্নাত অনুযায়ী চলেন।
যাতে সুন্নাত জীবিত হয় এবং মুসলিমগণ নিশ্চিতরূপে সাওয়াব ও বরকত লাভ করেন।
এ
সকল আলেম ও বুজুর্গগণের একজন সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী (রহ.)। তিনি এ বিষয়ে
আলোচনা কালে বলেন: এখন কেউ যদি প্রচলিত রুসূম অনুযায়ী এ সকল ফাতেহা, ইসালে
সাওয়াব, কুলখানী, ওরস ইত্যাদি পালন না-করেন তাহলে সুন্নাত বিষয়ে অজ্ঞ
মানুষেরা বলবে যে, তিনি আল্লাহর ওলী ও বুজুর্গগণের ভক্তি করেন না, তাঁদের
হক্ক আদায় করেন না বা তাঁদের প্রতি আদব রক্ষা করেন না। তার এই চিন্তার
মাধ্যমে তিনি বলতে চান যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
-এর আহলে বাইত, সাহাবীগণ, তাবেয়ী, তাবে-তাবেয়ী ও অন্যান্য নেককার
বুজুর্গগণ, যাঁরা এ সকল রেওয়াজ সমাজে প্রচলিত হওয়ার আগে চলে গিয়েছেন
তাঁরা সবাই তাঁদের পূর্ববর্তী বুজুর্গ ও আউলিয়াগণের প্রতি বেয়াদবী
করেছেন। উপরন্তু আমাদের নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম তাঁর পূর্বপুরুষ ও আল্লাহর খলীল ইবরাহীম এর প্রতিও একই রকম
বেআদবী করেছেন বলে দাবি করা হবে। নাঊযু বিল্লাহ!! নাঊযু বিল্লাহ!!!
এ বিষয়ে তিনি কিছু মূল্যবান নসীহত করেছেন :
প্রথমত,
সকল মৃত বুজুর্গ ও আপনজনের ক্ষেত্রেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম ও সাহাবীগণের সুন্নাত হুবহু পালন করা ও প্রতিষ্ঠা করাই
সর্বোত্তম। এজন্য কাফন, দাফন, জানাযা ও মাসনূন তিন দিনের শোক প্রকাশের
বাইরে কোনো প্রকারের রুসূম না-মানা প্রয়োজন। বিবাহের ওলীমা ছাড়া সকল
প্রকার খানাপিনার আয়োজন ও রুসূম রেওয়াজ পরিত্যাগ করতে হবে। এক্ষেত্রে
শুধুমাত্র রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কেই পেশওয়া,
মুরববী ও আদর্শ মানতে হবে। তাঁর আদর্শকে সামনে রেখে পারসিক, রোমীয়, মধ্য
এশিয়, ভারতীয় ইত্যাদি সকল রুসূম রেওয়াজ পরিত্যাগ করতে হবে। কারণ এগুলি
সবই তাঁর ও তাঁর সাহাবীগণের প্রচলিত রীতি ও তাঁদের তরীকার অতিরিক্ত কর্ম।
এগুলি বর্জন করতে হবে এবং এগুলির প্রতি নিজের ঘৃণা ও না-রাজি প্রকাশ করতে
হবে।
দ্বিতীয়ত, এ সকল রুসূমাতের মধ্যে নিয়্যাতগত ও কর্মগত অনেক গোনাহের কাজ রয়েছে, যার ফলে কেয়ামতের দিন এ সকল রুসূমাত পালনকারীকে কঠিন বিপদে পড়তে হবে। কেউ যদি একান্তই খালেস নিয়্যাতে, খালেসভাবে কোনোরকম দিনতারিখ স্থান বা পদ্ধতি নির্ধারণ না-করে কিছু খাওয়া দাওয়া করান তাহলে হয়ত তিনি সাওয়াব পাবেন। তবে তাকে মনে রাখতে হবে যে, মৃতকে সাওয়াব পাঠনো খানাপিনা করানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। দু‘আ ও দানই মৃতের সাওয়াব পাঠানোর সুন্নাত-সম্মত পদ্ধতি। খানাপিনা করানো দানের একটি প্রকরণ মাত্র। সাহাবীগণ এক্ষেত্রে এই প্রকরণ ব্যবহার করেন নি, বরং কূপ খনন, জমি বা বাগান ওয়াকফ করা ইত্যাদি কাজের মাধ্যমে দানের সাওয়াব প্রেরণ করেছেন। আমাদেরও এ সকল পদ্ধতিতে দান করা উচিত।
তৃতীয়ত, যদি আমরা এ সকল খেলাফে-সুন্নাত ও বিদ‘আত রুসূম রেওয়াজ পরিত্যাগ করতে না-পারি, তাহলে অন্তত সুন্নাতকে পূর্ণাঙ্গ মনে করতে হবে। কেউ যদি অবিকল সুন্নাত পদ্ধতিতে হুবহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তাঁর সাহাবীগণের মতো দু‘আ ও দানে রত থাকেন এবং সকল প্রকার কুলখানী, ইসালে সাওয়াব, ওরশ ইত্যাদি অনুষ্ঠান পরিত্যাগ করেন, তাহলে তাঁকে উত্তম ও পরিপূর্ণ সুন্নাতের অনুসারী বলে মহববত করতে হবে। এভাবে সকল বিষয়ে সুন্নাতকে পরিপূর্ণ ও আমাদের রুসূমকে খেলাফে সুন্নাত ও বিশেষ প্রয়োজনে বা বাধ্য হয়ে করছি বলে মনে করতে হবে।[12]
আল্লাহ তা‘আলা আমাদেরকে সকল বিষয়ে সুন্নাত তরীকা অবলম্বনের তাওফীক দান করুন। আমীন !!
সম্পাদকের কথা:
মৃত
ব্যক্তির জন্য করণীয় কাজসমূহের দ্বারা তার কাছে কী সাওয়াব পৌঁছে না কি
সেটার অসীলা দ্বারা দো‘আ করা হলে সেটা কাজে লাগে এ ব্যাপারে আহলে সুন্নাত
ওয়াল জামা‘আতের ইমামগণের মধ্যে দু’টি মত পাওয়া যায়।
এক.
শাইখুল ইসলাম ইবন তাইমিয়্যা, ইবনুল কাইয়েম রহ. সহ একদল আলেম মনে করেন যে
তাদের কাছে সাওয়াব পৌছে। এ ব্যাপারে তারা তাদের গ্রন্থে বিস্তারিত
আলোচনা করেছেন।
দুই.
পক্ষান্তরে অধিকাংশ আলেম মনে করেন, সওয়াব কেউ কাউকে দিতে পারে না, বরং
উচিত হবে সৎকাজ করে সেটার অসীলা দিয়ে দো‘আ করা। শাইখুল আলবানী রহ. সহ অনেক
বিদগ্ধ আলেম এমতটিকেই প্রাধান্য দিয়েছেন।
এ
দ্বিতীয় মতটিকে আমি প্রাধান্য দিয়ে থাকি। কিন্তু আমাদের লেখককে মনে
হচ্ছে প্রথম মতের প্রবক্তা। এ ব্যাপারে আমি তার মতামতের উপর হস্তক্ষেপ না
করে বিষয়টি বর্ণনা করে দেওয়া যুক্তিযু্ক্ত মনে করেছি।
আহলে সুন্নাত ওয়াল জামা‘আতের মতভেদটি দ্বান্দ্বিক নয় বরং প্রকারান্তিক। কারণ, সবাই মনে করেন যে শরী‘আতে
অনুমোদিত নয় এমন কোনো কাজ করলে সেটা বিদ‘আত হবে। যেমন উরস, চল্লিশা
(চেহলাম), পঞ্চ দিনের অনুষ্ঠান, কিংবা খতমে তাহলীল, খতমে খাজেগান,
নির্দিষ্ট দিনে দো‘আ অনুষ্ঠান, কুলখানি ইত্যাদি সকল বিষয় বিদ‘আত ও
পথভ্রষ্টতা। এ ব্যাপারে কারও কোনো দ্বিমত নেই।
আল্লাহ আমাদেরকে সুন্নাতের উপর পরিপূর্ণভাবে আমল করার তৌফিক দিন। আমীন।
No comments:
Post a Comment