Wednesday, April 20, 2016

হাশরের ময়দানে ৫টি প্রশ্

হাশরের ময়দানে ৫টি প্রশ্নঃ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ
কিয়ামতের দিন (হাশরের ময়দানে) বান্দা তার স্থানেই দাঁড়িয়ে থাকবে, যে পর্যন্ত না তাকে জিজ্ঞেস করা হবেঃ
১. তার জীবনকাল কিভাবে কাটিয়েছে,
২. তার জ্ঞান কি কাজে লাগিয়েছে,
৩. তার সম্পদ কোথা থেকে অর্জন করেছে,
৪. তার সম্পদ কোথায় খরচ করেছে এবং
৫. তার শরীর কিভাবে পুরানো করেছে?
[ইমাম তিরমিযীঃ ২৪১৭, হাদীসটি হাসান ও সহীহ]

Tuesday, April 19, 2016

কি ঘটেছিল কারবালার প্রান্তরে?

কি ঘটেছিল কারবালার প্রান্তরে?
যুগ যুগ ধরে প্রচার হয়ে আসা মিথ্যা কাহিনীটাই আমরা জানি, সত্যটা জানা দরকার।
লিখেছেনঃ শায়খ আব্দুল্লাহ শাহেদ আল-মাদানী।
_________________________
১০ই মুহাররম বা আশুরার দিন। এ দিনটি বিভিন্ন কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন। কিন্তু সেই বিভিন্ন কারণ বাদ দিয়ে যে উপলক্ষ্যে আমরা ছুটি কাটাই, তা হল কারবালার ঘটনা। শেষ নবী ও রসুল মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাতি ইমাম হুসাইন ইবনে আলী (রাদিয়াল্লাহু তাআলা আনহু) এদিন কারবালাতে মুসলিম নামধারী কিছু মুনাফিকের হাতে শহীদ হন। তিনি অত্যন্ত সৎ, সজ্জন এবং সাহসী সাহাবা ছিলেন। রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের পরে তিনিও আমাদের খুব প্রিয় একজন নেতা। কিন্তু ইসলামের অন্যান্য অনেক বিষয়ের মত তার মৃত্যু সম্পর্কে সত্য ইতিহাসটা আমরা জানি না, জানার চেষ্টাও করি না।
আসলে কি হয়েছিল?
৬০ হিজরির ঘটনা। ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়াকে খলিফা নিযুক্ত করেন তার বাবা মুআবিয়া (রাঃ), কিন্তু এটা ইসলামের মর্মের চেয়ে রাজতান্ত্রিক ধারায় বেশী প্রভাবিত ছিল। তাই তার হাতে বায়াত করেননি হুসাইন (রাঃ), ইরাকের লোকেরা এ খবর পেয়ে তার কাছে চিঠি/দূত পাঠিয়ে জানাল তারা তাকে খলিফা হিসেবে চায়, ইয়াজিদকে নয়। সমর্থকদের চিঠি পেয়ে হুসাইন (রাঃ) তাঁর চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকীলকে কুফায় পাঠালেন, সেখানকার অবস্থা দেখার জন্য। মুসলিম দেখলেন যে আসলেই অনেক মানুষ হুসাইনকে (রাঃ) কে খলিফা হিসেবে চাচ্ছে। তিনি হুসাইন (রাঃ) কে সেটা জানিয়েও দিলেন। ইতমধ্যে কিছু অত্যুৎসাহী লোকেরা হানী বিন উরওয়ার ঘরে মুসলিমের হাতে হুসাইনের পক্ষে বায়াত নেওয়া শুরু করল। সিরিয়াতে ইয়াজিদের কাছে এ খবর পৌছালে সে বসরার গভর্নর উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে পাঠাল কুফাবাসীর বিদ্রোহ দমন করতে।
উবাইদুল্লাহ কুফায় গিয়ে দেখে ঘটনা সত্যি। মুসলিম বিন আকীল চার হাজার সমর্থক নিয়ে উবাইদুল্লাহ বিন জিয়াদের প্রাসাদ ঘেরাও করলেন। এ সময় উবাইদুল্লাহ দাঁড়িয়ে এক ভাষণ দিয়ে মানুষকে ইয়াজিদের সেনা বাহিনীর ভয় দেখাল। কুফাবাসীরা ইয়াজিদের শাস্তির ভয়ে আস্তে আস্তে সরে পড়তে লাগল। সূর্য অস্ত যাওয়ার পর মুসলিম বিন আকীল দেখলেন, তথাকথিত হুসাইন সমর্থকদের কেউই অবশিষ্ট নেই। তাকে গ্রেপ্তার করে হত্যার আদেশ দিল উবাইদুল্লাহ। মুসলিম মৃত্যুর আগে হুসাইনের কাছে একটি চিঠি পাঠান
হুসাইন! পরিবার-পরিজন নিয়ে ফেরত যাও। কুফা বাসীদের ধোঁকায় পড়ো না। কেননা তারা তোমার সাথে মিথ্যা বলেছে। আমার সাথেও তারা সত্য বলেনি।
এদিকে মুসলিম বিন আকীলের মৃত্যু হলেও তার প্রথম চিঠির উপর ভিত্তি করে যুলহিজ্জা মাসের ৮ তারিখে হুসাইন (রাঃ) মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে রওনা দেন। অনেক সাহাবী তাকে বের হতে নিষেধ করেছিলেন। তাদের মধ্যে আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস, আব্দুল্লাহ ইবনে উমর, আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর, আব্দুল্লাহ বিন আমর এবং হুসাইন (রাঃ) এর ভাই মুহাম্মাদ ইবনুল হানাফীয়ার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
সুফীয়ান আস সাওরী ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে সহীহ সূত্রে বর্ণনা করেন যে, ইবনে আব্বাস (রাঃ) হুসাইনকে বলেছিলেন, মানুষের দোষারোপের ভয় না থাকলে, আমি তোমার ঘাড়ে ধরে তোমাকে কুফাতের যাওয়া থেকে ফিরিয়ে রাখতাম।
আব্দুল্লাহ ইবনে যুবাইর (রাঃ) হুসাইনকে বলেন, হুসাইন! কোথায় যাও? এমন লোকদের কাছে, যারা তোমার পিতাকে হত্যা করেছে এবং তোমার ভাইকে আঘাত করেছে?
যাত্রা পথে হুসাইনের কাছে মুসলিমের সেই চিঠি এসে পৌঁছল। চিঠি পড়ে তিনি কুফার পথ পরিহার করে ইয়াজিদের কাছে যাওয়ার জন্য সিরিয়ার পথে অগ্রসর হতে থাকলেন। পথিমধ্যে ইয়াজিদের সৈন্যরা আমর বিন সাদ, সীমার বিন যুল জাওশান এবং হুসাইন বিন তামীমের নেতৃত্বে কারবালার প্রান্তরে হুসাইনের (রাঃ) গতিরোধ করল। তিনি আগত সৈন্যদলকে আল্লাহর দোহাই এবং নিজের মর্যাদার কথা উল্লেখ করে তিনটি প্রস্তাব দেন
১. তাকে ইয়াজিদের দরবারে যেতে দেয়া হোক। তিনি সেখানে গিয়ে ইয়াজিদের হাতে বায়াত গ্রহণ করবেন। কেননা তিনি জানতেন যে, ইয়াজিদ তাঁকে হত্যা করতে চান না।
২. অথবা তাঁকে মদিনায় ফেরত যেতে দেয়া হোক।
৩. অথবা তাঁকে কোন ইসলামী অঞ্চলের সীমান্তের দিকে চলে যেতে দেয়া হোক। সেখানে তিনি জিহাদ করবেন এবং ইসলামী রাজ্যের সীমানা পাহারা দেবেন।
ইয়াজিদের সৈন্যরা উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদের ফয়সালা ছাড়া কোন প্রস্তাবই মানতে রাজী হল না। এ কথা শুনে উবাইদুল্লাহর এক সেনাপতি হুর বিন ইয়াজিদ বললেন, এরা তোমাদের কাছে যেই প্রস্তাব পেশ করছে তা কি তোমরা মানবে না? আল্লাহর কসম! তুর্কী এবং দায়লামের লোকেরাও যদি তোমাদের কাছে এই প্রার্থনাটি করত, তাহলে তা ফেরত দেয়া তোমাদের জন্য বৈধ হত না।
এরপরও তারা হুসাইন (রাঃ) এর অত্যন্ত যৌক্তিক এই প্রস্তাবগুলো মেনে নেয়নি। সেই সেনাপতি ঘোড়া নিয়ে সেখান থেকে চলে আসলেন হুসাইন (রাঃ) ও তাঁর সাথীদের সালাম দিয়ে উবাইদুল্লাহ এর সৈনিকদের সাথে হুসাইনের পক্ষে যুদ্ধ করে নিহত হলেন।
সৈন্য সংখ্যার দিক থেকে হুসাইনের সাথী ও ইয়াজিদের সৈনিকদের মধ্যে বিশাল পার্থক্য ছিল। হুসাইনের (রাঃ) এর সাথে ছিলেন
১. আলী (রাঃ) এর ছেলেরা - আবু বকর, মুহাম্মাদ, উসমান, জাফর এবং আব্বাস।
২. হুসাইনের (রাঃ) নিজের সন্তানেরা - আবু বকর, উমর, উসমান, আলী আকবার এবং আব্দুল্লাহ।
৩. হাসান (রাঃ) এর ছেলেদের মধ্যে থেকে - আবু বকর, উমর, আব্দুল্লাহ এবং কাসেম।
৪. আকীলের সন্তানদের মধ্যে হতে - জাফর, আব্দুর রাহমান এবং আব্দুল্লাহ বিন মুসলিম বিন আকীল।
৫. আব্দুল্লাহ বিন জাফরের সন্তানদের মধ্যে হতে - আউন এবং আব্দুল্লাহ।
সাহাবা এবং তাবেঈদের এই ছোট্ট দলটির সবাই বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে নিহত হন। অবশেষে হুসাইন (রাঃ) ছাড়া আর কেউ জীবিত রইলেন না। সীমার বিন যুল জাওশান নামের এক নরপশু বর্শা দিয়ে হুসাইনের (রাঃ) শরীরে আঘাত করে ধরাশায়ী করে ফেলল। শেষে ইয়াজিদ বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে নির্ভীক এই বীর আল্লাহর লিখে রাখা ভাগ্যানুযায়ী শহীদ হলেন, ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। হুসাইন (রাঃ) অন্যায় কিছু বলেন নি, অন্যায় কিছু করেন নি। তার হত্যাকারী ও হত্যায় সাহায্যকারীদের আল্লাহর ক্রোধ ঘেরাও করুক, এরা ধ্বংস হোক! আল্লাহ্ তায়ালা শহীদ হুসাইন (রাঃ) এবং তাঁর সাথীদেরকে স্বীয় রহমত ও সন্তুষ্টি দ্বারা আচ্ছাদিত করুন।
এ ঘটনা মুসলিম জাতির ইতিহাসের একটি লজ্জাজনক অধ্যায় যা বিশ্বাসঘাতক কুফাবাসী আমাদের উপহার দিয়েছে। এরপরে তারা এতে রঙ মাখিয়ে গল্প বানিয়েছে - পাথর উল্টালে রক্ত বের হওয়া, সূর্যগ্রহণ, আকাশের দিগন্ত লাল হওয়া, আকাশ থেকে পাথর পড়া ইত্যাদি। আল্লাহ যদি চাইতেন তিনি এইসব আজগুবি ঘটনা না ঘটিয়েই হুসাইন (রাঃ) ও তার সঙ্গীদের রক্ষা করতে পারতেন।
হুসাইন (রাঃ) এর হত্যাকারী কে?
শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইম্যিয়া (রহঃ) বলেন,
সকল মুহাদ্দিস ও ঐতিহাসিকের ঐক্যমতে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়া হুসাইনকে (রাঃ) হত্যা করার আদেশ দেয়নি। বরং, উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকে ইরাকে হুসাইনকে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বাঁধা দিতে বলেছিল। এতটুকুই ছিল তার ভূমিকা। বিশুদ্ধ মতে তার কাছে যখন হুসাইন (রাঃ) নিহত হওয়ার খবর পৌঁছলে সে আফসোস করেছিল। সে হুসাইন (রাঃ) পরিবারের কোন মহিলাকে বন্দী বা দাসীতে পরিণত করেনি; বরং পরিবারের জীবিত সকল সদস্যকে সসম্মানে মদিনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছিল।
ইবনে আবী নুম হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেন, আমি একদা আব্দুল্লাহ ইবনে উমরের নিকট উপস্থিত ছিলাম। তখন একজন লোক তাঁকে মশা মারার বিধান জানতে চাইল। তিনি তখন লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কোন দেশের লোক? সে বলল, ইরাকের। ইবনে উমর (রাঃ) তখন উপস্থিত লোকদেরকে লক্ষ্য করে বললেন, তোমরা এই লোকটির প্রতি লক্ষ্য কর। সে আমাকে মশা মারার হুকুম জিজ্ঞেস করছে, অথচ তারা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর নাতি (হুসাইন রাঃ কে) হত্যা করেছে। আর আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বলতে শুনেছি, এরা দুজন (হাসান ও হুসাইন) আমার দুনিয়ার দুটি ফুল।
সহীহুল বুখারী, হাদীছ নং- ৫৯৯৪।
হুসাইন (রাঃ) নিহত হওয়ার পূর্বে ইরাকবাসীদের বলেন,
তোমরা কি চিঠির মাধ্যমে আমাকে এখানে আসতে আহবান করো নি? আমাকে সাহায্য করার ওয়াদা করো নি? অকল্যাণ হোক তোমাদের! যেই অস্ত্র দিয়ে আমরা ও তোমরা মিলে ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছি এখন সেই অস্ত্র তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে চালাতে যাচ্ছ? মাছি যেমন উড়ে যায় তেমনি তোমরা আমার পক্ষে কৃত বায়াত থেকে সড়ে যাচ্ছ, সকল ওয়াদা-অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছ। ধ্বংস হোক এই উম্মতের তাগুতের দলেরা।
হুসাইন (রাঃ)  তাঁর পূর্বের সমর্থকদের বিরুদ্ধে একটি বদ দুআও করেন,
হে আল্লাহ! আপনি যদি তাদের হায়াত দীর্ঘ করেন, তাহলে তাদের দলের মাঝে বিভক্তি সৃষ্টি করে দিন। তাদেরকে দলে দলে বিচ্ছিন্ন করে দিন। তাদের শাসকদেরকে তাদের উপর কখনই সন্তুষ্ট করবেন না। তারা আমাদেরকে সাহায্য করবে বলে ডেকে এনেছে। অতঃপর আমাদেরকে হত্যা করার জন্য উদ্যত হয়েছে।
হুসাইনের (রাঃ) এই দুয়া প্রমাণ করে যে, ইয়াজিদ প্রত্যক্ষভাবে হুসাইনের (রাঃ) হত্যায় জড়িত ছিল না। কেননা তিনি দুআয় বলেছেন, হে আল্লাহ! আপনি তাদের শাসকদেরকে তাদের উপর কখনই সন্তুষ্ট করবেন না।
এ থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, ইরাকবাসী শিয়ারা উমাইয়া শাসকদের সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় হুসাইনের (রাঃ) এর সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিলো। তবে আল্লাহ সুবহানাহু তাআলা হুসাইন (রাঃ) এর দুআ কবুল করে নেন। পরবর্তীতে উবাইদুল্লাহ বিন যিয়াদকেও ইয়াজিদের আদেশে হত্যা করা হয়েছিলো।
আমাদের করণীয়ঃ
আমাদের সালফে সালেহীনরা (এই উম্মতের পূর্ববর্তী নেককার লোকদের) কেউই ইয়াজিদের নামের শেষে রাহিমাহুল্লাহ বা লানাতুল্লাহ আলাই - এ দুইটি বাক্যের কোনটিই উল্লেখ করেন নি। অর্থাৎ, কেউ তাকে ধ্বংস হওয়ার জন্যে বদদুয়া বা তার জন্যে রহমতের দুয়া কোনটাই করেন নি। সুতরাং সে যেহেতু তার আমল নিয়ে চলে গেছে, তাই তার ব্যাপারে আমাদের চুপ থাকাই ভাল। তার ভাল মন্দ আমলের হিসাব সে দেবে, আমাদেরটা আমরা। আমরা ইয়াজীদকে গালি দেব না, তবে রাকে ভালবাসার প্রশ্ন তো ওঠেই না। তার চেয়ে হুসাইন (রাঃ) ইমামাতের অনেক বেশি যোগ্য ছিলেন, বহু গুণে শ্রেষ্ঠ মানুষ ছিলেন, তাতে কোন সন্দেহ নেই। কিন্তু আল্লাহ যাকে খুশি তাকে রাজত্ব দেন, এটাই আল্লাহর রুবুবিয়াত।
কোন ধরণের জন্ম-মৃত্যু বার্ষিকী পালনের প্রথা ইসলামে নেই। মুসলিম হিসেবে আমাদের রসুলুল্লাহ সাল্লালাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শিক্ষা দিয়েছেন, মৃত বা শহীদ ব্যক্তির জন্য বিলাপ না করা, আনুষ্ঠানিকভাবে তিন দিনের বেশি শোক প্রকাশ না করা। তিনি বলেছেন,
মৃত ব্যক্তির উপর বিলাপকারী যদি তওবা না করে মারা যায়, তাকে কিয়ামতের দিন লোহার কাঁটাযুক্ত জামা পড়ানো হবে এবং আলকাতরার প্রলেপ লাগানো পায়জামা পড়ানো হবে।
সহীহ মুসলিম।
যে কোন বিপদে আমাদের কর্তব্য কুরআনের সেই বাণী স্মরণ করা,
যখন তাঁরা বিপদে পতিত হয়, তখন বলে, নিশ্চয়ই আমরা সবাই আল্লাহর জন্য এবং আমরা সবাই তারই সান্নিধ্যে ফিরে যাবো।
সুরা বাকারাঃ ১৫৬।
রসুলের সুন্নাত ভালবাসলে আমাদের উচিত এই দিনে সিয়াম পালন করা। আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন: নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনায় কিছু ইহুদীদের আশুরার দিন রোজা রাখতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এটি কিসের রোজা? তারা উত্তর দিল, এটি একটি পবিত্র দিন। এই দিনে আল্লাহ বনী ইসরাইলকে তাদের শত্রুদের কবল থেকে পরিত্রাণ দিয়েছেন। তাই মুসা (আঃ) এ দিন রোজা রেখেছেন। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তখন বললেন, তাদের চাইতে মুসা (আঃ) এর সাথে আমার সম্পর্ক অধিক। সুতরাং তিনি (আশুরার দিনে) সিয়াম থাকলেন এবং সাহাবীদেরকে সিয়াম রাখার আদেশ দিয়েছেন। (সহীহ বুখারী)
অপর বর্ণনায় তিনি আগামী বছর নয় তারিখেও সিয়াম থাকার নিয়ত করেছিলেন।

আল্লাহ আমাদের সত্যটা জেনে, সস্তা আবেগ ছেড়ে সঠিক আমল করার তৌফিক দিন। আমিন।

Saturday, April 16, 2016

বিতির সালাত কাযা পড়ার নিয়ম

বিতির সালাত কাযা পড়ার নিয়মঃ
যারা রাতে বিতির পড়তে পারেন নি কিন্তু ফযরের ওয়াক্ত হয়ে গেছেঃ
১. বিতির সালাতের অনেক সওয়াব, ইচ্ছা হলে কাযা পড়তে পারেন। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কেউ বিতির পড়তে না পারলে কাযা পড়তে বলেছেন, তিনি নিজেও কজনো অসুস্থতার কারণে ফযরের পূর্বে বিতির পড়তে না পারলে, পরে ভোরবেলা কাযা পড়ে নিতেন।
২. বিতির সালাতের কাযা হলে সূর্য উদয় হয়ে বেলা উঠার পরে বা যখনই মনে পড়বে তখনই পড়তে হবে।
৩. বিতির সকাল বেলা কাযা পড়লে ১/৩/৫ বিজোড় করে পড়া যাবেনা। যিনি বিতির ১ রাকাত পড়তেন তিনি সকাল বেলা কাযা পড়লে ২ রাকাত পড়বেন, যিনি ৩ রাকাত পড়তেন তিনি ২ সালামে ২+২=৪ রাকাত পড়বেন।
এ সম্পর্কিত হাদীসগুলোঃ
১. বিতির সালাত হচ্ছে ১, ৩ বা ৫ রাকাত, যার যত রাকাত ভালো লাগে সে তাই পড়বে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, বিতির সলাত (হক্ক) সত্য। অতএব, কেউ চাইলে তা পাঁচ রাকাতও পড়তে পারে, তিন রাকাতও পড়তে পারে এবং এক রাকাতও পড়তে পারে।
সুনানে নাসায়ীঃ ১৭১০-১৭১৩; মুসনাদে আহমাদঃ ১৪২২,২৩০৩৩; সুনানে দারিমীঃ ১৫৮২।
হাদীসের তাহক্বীক্বঃ শায়খ আলবানী (রহঃ) হাদীসটিকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন। মিশকাতঃ ১২৬৫, সহীহ আবু দাউদঃ ১২৭৮।
২. বিতির কাযা পড়া যাবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি বিতির সলাত না পড়ে ঘুমিয়ে গেলো বা তা পড়তে ভুলে গেলো, সে যেন ভোরবেলা অথবা যখন তার স্মরণ হয় তখন তা পড়ে নেয়।
সুনানে ইবনে মাজাহ্ঃ হাদিস নং ১১৮৮।
তাহক্বীক্বঃ শায়খ আলবানী (রহঃ) হাদীসটিকে সহীহ আখ্যা দিয়েছেন। তাখরীজুল মিশকাতঃ ১২৬৮, ১২৭৯; ইরওয়াহ গালীলঃ ২/১৫৩।
৩. বিতির কাযা পড়লে বিজোড় নয়, জোড় করে পড়তে হবে। মা আয়িশাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিত, (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর) কখনো নিদ্রা বা কোন ব্যাধি তাঁর রাত জেগে ইবাদতের ব্যাপারে সংঘাত ঘটালে তিনি দিনের বেলা বার (১২) রাকাত সালাত আদায় করে নিতেন।
সহীহ মুসলিম, খন্ড ৪, হাদিস নং ১৬২৩, মুসাফিরের স্বলাত ও কসর স্বলাতের অধ্যায়
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম রাতের সালাত (তাহাজ্জুদ+বিতির) সর্বদা ১১ রাকাত পড়তেন। কিন্তু কখনো অসুস্থতার কারণে ফযরের পূর্বে পড়তে না পারলে ভোরবেলা পড়লে ১১ এর পরিবর্তে ১২ পড়ে নিতেন। সুতরাং, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর সুন্নাহ অনুযায়ী যে ব্যক্তি ১ রাকাত বিতির পড়তো তিনি ২, যিনি ৩ পড়তেন তিনি ৪ রাকাত পড়বেন, যিনি ৫ রাকাত বিতির পড়তে অভ্যস্ত তিনি ৬ পড়বেন। উল্লেখ্য, ৪ বা ৬ পড়লে ২+২=৪ বা ২+২+২=৬ এইভাবে পড়তে হবে, এবং প্রত্যেকে ২ রাকাত শেষে বৈঠক করে সালাম ফেরাতে হবে।

Tuesday, April 12, 2016

ঘুমানোর আগে গুরুত্বপূর্ণ ৭টি সুন্নতী আমল

ঘুমানোর আগে গুরুত্বপূর্ণ ৭টি সুন্নতী আমল 

১. আয়াতুল কুরসী পাঠ করা – ১ বার।
ঘুমানোর পূর্বে আয়াতুল কুরসী পাঠ করার ফযীলতঃ
ক. সকাল পর্যন্ত তার জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে একজন হেফাজতকারী (ফেরেশতা) তাকে নিরাপত্তা দেবে।
খ. শয়তান তার কাছে আসতে পারবেনা।
“যখন বিছানায় ঘুমুতে যাবে আয়াতুল কুরসী পাঠ করবে, তাহলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তোমার উপর সব সময় একজন হেফাযতকারী নিযুক্ত থাকবে এবং ভোর পর্যন্ত শয়তান তোমার ধারে কাছেও আসতে পারবে না।”
সহীহ বুখারী, খন্ড ৬, অধ্যায় ৬১, হাদিস নং- ৫৩০।
*এখানে হাদীসটা আসলে সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা আসলে এক জিনের সাথে এক সাহাবীর আশ্চর্যজনক বড় একটা ঘটনা। সম্পূর্ণ কাহিনীটা জানার জন্য আপনারা রিয়াদুস সালেহীন এর বই ৯, হাদিস নং- ১০২২ থেকে দেখে নিতে পারেন।
_____________________________
২. সুরা বাক্বারার শেষ দুই আয়াত পড়া – ১ বার।
ঘুমানোর আগে সুরা বাক্বারার শেষ ২ আয়াত (২৮৫+২৮৬) পড়ার ফযীলতঃ
ক. রাত জেগে তাহাজ্জুদ নামায পড়ার সমান সওয়াব পাওয়া যাবে
খ. বালা-মুসিবত ও যেকোনো ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ঠ হবে।
গ. জিন ও শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ঠ হবে।
ঘ. আয়াতগুলো পড়ে শেষ “আমিন” বললে আয়াতগুলোতে যেই দুয়া আছে সেইগুলো আল্লাহ তাআ’লা কবুল করে নেন।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি রাতের বেলা সুরা বাকারার শেষ দুই আয়াত পড়বে সেটা তার জন্য যথেষ্ঠ হবে”।
সহীহ বুখারিঃ ৫০১০, সহীহ মুসলিমঃ ৮০৭।
বিখ্যাত হাদীস গ্রন্থ “রিয়াদুস সালেহীন” এর লেখক ও সহীহ মুসলিমের ভাষ্যকার, ইমাম আন-নববী (রহঃ) বলেন, “এর অর্থ কেউ বলেছেনঃ কিয়ামুল লাইল বা তাহাজ্জুদ নামাযের জন্য যথেষ্ঠ হবে। কেউ বলেছেনঃ শয়তানের ক্ষতি থেকে বাঁচার জন্য যথেষ্ঠ হবে। কেউ বলেছেনঃ বালা-মুসিবত থেকে নিরাপত্তা পাওয়া যাবে। তবে সবগুলো অর্থ সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শারহুন নববী আ’লা সহিহ মুসলিমঃ ৬/৩৪০, হাদীস ৮০৭।
সহীহ বুখারীর ভাষ্যকার, আমিরুল মুমিনিন ফিল হাদীস, ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী (রহঃ) এই অভিমত সমর্থন করে বলেন, উপরের সবগুলো অর্থ নেওয়া সঠিক। আল্লাহ ভালো জানেন। প্রথম অর্থটি (তাহাজ্জুদের সমান সওয়াব পাওয়া) আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউ’দ (রাঃ) থেকে একটি মারফু হাদীসে স্পষ্ট উল্লেখ আছে।
ফাতহুল বারী ৮/৬৭৩, হাদীস ৫০১০।
এ কারণেই আলী (রাঃ) বলেনঃ
“আমার মতে যার সামান্যও বুদ্ধিজ্ঞান আছে, সে এ দুটি আয়াত পাঠ করা ছাড়া নিদ্রা যাবে না”।
মানাকিবুস সাহাবা। ইমাম নববী এটাকে সহীহ বলেছেন, আল-আযকার।
_____________________________
৩. ঘুমানোর আগে সুরা কাফিরুন পড়া – ১ বার
উপকারীতাঃ শিরক থেকে বাচতে সাহায্য করবে।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“(ক্বুল ইয়া আয়্যুহাল কাফিরুন বা সুরা কাফিরুন), এই সুরাটিতে শিরক থেকে বাঁচার শিক্ষা রয়েছে।”
আবু দাউদঃ ৫০৫৫, তিরমিযী, আহমাদ, ইমাম ইবেন হাজার আসকালানী ও শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।
১০০০ সুন্নত, পৃষ্ঠা – ১৬০।
ফরওয়া ইবন নাওফাল (র) থেকে বর্ণিত তিনি নবী (স) এর কাছে এসে বললেনঃ ইয়া রাসুলুল্লাহ (সঃ)! আমাকে এমন কিছু শিখিয়ে দিন যা আমি আমার শয্যাগ্রহণের সময় বলতে পারি। তিনি বললেনঃ ক্কুল ইয়া আয়্যুহাল কাফিরুন সূরাটি পাঠ করবে। কেননা এটি হল শিরকের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ঘোষনা।
সুনানে আত-তিরমিজি, দু’আ অধ্যায়, অধ্যায় ৪৮, হাদীস নং- ৩৪০৩। হাদীসটি হাসান সহীহ, দারুস সালাম।
______________________________
৪. সুরা ইখলাস পাঠ করা – ১ বার, ৩ বার অথবা ১০ বার অথবা, যার যতবার পড়তে ভালো লাগে। তবে ৩ বার পড়লে যেহেতু এক কুরান খতম করার সমান, সুতরাং ৩ করা যেতে পারে। কারো ইচ্ছা হলে আরো বেশি ১০ বারও করতে পারেন – ১০ বার সুরা ইখলাস পড়লে তার জন্য জান্নাতে একটা বাড়ি বানানো হয়।
ক. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সাহাবীগণকে বললেন, “তোমরা কি এক রাতে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়তে পারনা”? প্রস্তাবটি সাহাবাদের জন্য কঠিন মনে হল। তাই তাঁরা বলে উঠলেন, “হে আল্লাহর রসুল! এই কাজ আমাদের মধ্যে কে করতে পারবে”? (অর্থাৎ কেউ পারবে না।). তিনি বললেন, “ক্বুল হুওয়াল্লাহু আহাদ, আল্লাহুস স্বামাদ” (সুরা ইখলাস) কুরআনের এক তৃতীয়াংশের সমান”।. (অর্থাৎ এই সুরা পড়লে এক তৃতীয়াংশ কুরআন পড়ার সমান নেকী পাওয়া যাবে)।
সহীহুল বুখারী ৫০১৫, নাসায়ী ৯৯৫, আবু দাউদ ১৪৬১, আহমাদ ১০৬৬৯।
খ. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“যে ব্যক্তি সুরা ইখলাস ১০ বার পাঠ করবে, তার জন্য জান্নাতে একটি ঘর বানানো হবে”।
সহীহ আল-জামি আস-সগীর ৬৪৭২।
_______________________________
৫. তাসবীহ’, তাহ’মীদ ও তাকবীর পাঠ করাঃ
৩৩ বার তাসবীহ’ (সুবহা’নাল্লাহ), ৩৩ বার তাহ’মীদ (আলহা’মদুলিল্লাহ), ও ৩৪ বার তাকবীর (আল্লাহু আকবার) পাঠ করার ফযীলতঃ
ক. কারো একজন দাস থাকলে দিনে-রাতে যে সেবা-যত্ন ও সাহায্য করতো তার থেকেও বেশি উপকার পাওয়া যাবে এই আমল করলে।
খ. মোট ১০০ বার পড়লে, মীযানে ১০০০ নেকীর সমান হবে।
ক. আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহু আমার কাছে আটা পেষার দরুন তার হাতে ফোসকা পড়ে যাওয়ার অভিযোগ করলেন। আমি বললাম তোমার পিতা (রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর কাছে গিয়ে যদি একটা খাদেমের আবদার জানাতে।
(ফাতেমা রাদিয়াল্লাহু আনহু যখন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে খাদেম দেওয়ার কথা বললেন তখন) তিনি (রাসুল) বললেনঃ তোমার জন্য কি খাদেমের চাইতে উত্তম কোন কিছু বলব না? (তা হল) তোমরা যখন তোমাদের শয্যাগ্রহণ করবে তখন আলহা’মদু লিল্লাহ ৩৩ বার, সুবহা’নাল্লাহ ৩৩ বার এবং আল্লাহু আকবার ৩৪ বার পড়বে।
সুনানে আত-তিরমিজি, দু’আ অধ্যায়, অধ্যায় ৪৮, হাদীস নং- ৩৪০৮। হাদীসটি সহীহ, দারুস সালাম।
খ. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ
“যখন শয্যাগ্রহণ করবে তখন সুবহানাল্লাহ, আল্লাহু আকবার এবং আলহামদু লিল্লাহ পাঠ করবে একশত বার। এটা তোমাদের যবানে তো হল একশ, কিন্তু মীযানের পাল্লায় হবে এক হাজার (নেকী)।
সুনানে আত-তিরমিজি, দু’আ অধ্যায়, অধ্যায় ৪৮, হাদীস নং- ৩৪১০। হাদীসটি হাসান সহীহ, দারুস সালাম।
____________________________
৬. ঘুমানোর দুয়া পড়াঃ
ডান কাতে শুয়ে ঘুমানো সুন্নত। ডান কাতে শুয়ে ঘুমানোর আগে এই দুয়া পড়তে হবেঃ
بِاسْمِكَ اللَّهُمَّ أَمُوتُ وَأَحْيَا
উচ্চারণঃ বিস্মিকাল্লা-হুম্মা আমুতু ওয়া আহ্ইয়া।
অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনার নাম নিয়েই আমি মৃত্যুবরণ করছি (ঘুমাচ্ছি) এবং আপনার নাম নিয়েই জীবিত (জাগ্রত) হবো।
সহীহ বুখারীঃ ৬৩২৪, সহীহ মুসলিমঃ ২৭১১।
ঘুম থেকে উঠে যেই দুয়া পড়তে হয়ঃ
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِيْ أَحْيَانَا بَعْدَ مَا أَمَاتَنَا، وَإِلَيْهِ النُّشُوْرُ
উচ্চারণঃ আলহা’মদু লিল্লা-হিল্লাযী আহ্ইয়া-না- বাঅ’দা মা- আমা-তানা- ওয়া ইলাইহিন্-নুশুর।
অর্থঃ সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ্র জন্য, যিনি (নিদ্রারূপ) মৃত্যুর পর আমাদেরকে পুনরায় জীবিত করেছেন, আর আমরা সবাই তাঁরই কাছে ফিরে যাবো।
সহীহ বুখারীঃ ৬৩১৪, সহীহ মুসলিমঃ ২৭১১।
______________________________
৭. সুরা মুলক পড়া
প্রতিদিন (দিনে বা রাতে যেকোনো এক সময়) সুরা মুলক মুলক তেলাওয়াত করা গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নতঃ
***অনেকে মনে করে, এটা রাতেই পড়তে হবে, এটা ঠিক না। কেউ রাতে পড়লে ভালো। তবে সুবিধামতো সময়ে দিনে রাতে, যেকোনো সময়েই পড়া যাবে।
“রাসুলুল্লাহ (সাঃ) আলিফ লাম মীম তানজিলুল কিতাব (সুরা আস-সাজদা) ও তাবারাকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুলকু (সুরা মুলক) তেলাওয়াত না করে কোনদিন ঘুমাতেন না”।
সুনানে আত-তিরমিযী ২৮৯২, মুসনাদে আহমাদ ১৪২৯। শায়খ আলবানীর মতে হাদীসটি সহীহ, সহীহ তিরমিযী ৩/৬।
***এই সুরাটি নিয়মিত প্রতিদিন তেলাওয়াত করলে কবরের আজাব থেকে সুরক্ষা করবেঃ
আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রাঃ) বলেছেনঃ “যে ব্যক্তি প্রতিদিন রাতের বেলা তাবারাকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুলক (সুরা মুলক) তেলাওয়াত করবে আল্লাহ তাকে কবরের আজাব থেকে রক্ষা করবেন। রাসুলুল্লাহ (সাঃ) এর যামানায় এই সুরাটিকে আমরা “আল-মা’আনিয়াহ” বা সুরক্ষাকারী বলতাম। যে রাতের বেলা এই সুরাটি পড়বে সে খুব ভালো একটা কাজ করলো”।
সুনানে আন-নাসায়ী ৬/১৭৯। শায়খ আলবানীর মতে হাদীসটি হাসান সহীহ, সহীহ আত-তারগীব ওয়াল তারহীব ১৪৭৫।
***এই সুরা প্রত্যেকদিন রাতের বেলা তেলাওয়াত করলে কিয়ামতের দিন শাফায়াত করে জান্নাতে নিয়ে যাবে ইন শা’ আল্লাহঃ
রাসুলুল্লাহ (সাঃ) বলেছেনঃ “কুরআনে এমন একটা সুরা আছে যার মধ্যে ৩০টা আয়াত রয়েছে যেটা একজন ব্যক্তির জন্য সুপারিশ করবে এবং তাকে ক্ষমা করে দেওয়া হবে। আর সেটা হলো তাবারাকাল্লাযী বিয়াদিহিল মুলকু (সুরা মুলক)”।
সুনানে আত-তিরমিযী ২৮৯১, সুনানে আবু দাউদ ১৪০০, মুসনাদের আহমাদ, ইবনে মাজাহ ৩৭৮৬।
ইমাম তিরমিযী বলেছেন হাদীসটি হাসান, ইবনে তাইমিয়্যা বলেছেন সহীহ মাজমু ২২/২২৭, শায়খ আলবানীর মতে হাদীসটি সহীহ, সহীহ তিরমিযী ৩/৬, সহীহ ইবনে মাজাহ ৩০৫৩।
বিঃদ্রঃ এইখানে তেলাওয়াত মানে শুধু তোতা পাখির মতো রিডিং পড়ে যাওয়া না।
এই প্রসংগে সউদী আরবের স্থায়ী ফতোয়া বোর্ডের আলেমদের ফতোয়া হচ্ছে,
“এই হাদীসগুলোর আলোকে বলা যায়ঃ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য সুরা মুলক বিশ্বাস করবে ও তেলাওয়াত করবে, এই সুরাতে যে শিক্ষা দেওয়া আছে তা গ্রহণ করবে এবং যে হুকুম আহকাম দেওয়া আছে সেইগুলো মেনে চলবে কেয়ামতের দিন তার জন্য এই সুরাটি শাফায়াত করবে”।
ফতাওয়া আল-লাজনাহ আদ-দায়িমাহ ৪/৩৩৩, ৩৩৫।

আল-সুনান আল-রাওয়াতিব = পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতের পূর্বে ও পরে মোট ১২ রাকাত সুন্নত সালাত

আল-সুনান আল-রাওয়াতিব
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পাঁচ ওয়াক্ত ফরয সালাতের পূর্বে ও পরে মোট ১২ রাকাত সুন্নত সালাত নিয়মিত আদায় করতেন, বিশেষ কোন কারণ ছাড়া তা ত্যাগ করতেন না। এমনকি কখনো অনিচ্ছাকৃতভাবে এই সুন্নত সালাতের কোন একটা ছুটে গেলে পরে তিনি তার কাযা আদায় করে নিতেন। এই ১২ রাকাত সুন্নত সালাতকে আল-সুনান আল-রাওয়াতিব বলা হয়। এই ১২ রাকাত সুন্নত সালাতের অনেক বড় ফযীলত রয়েছে। আল-সুনান আল-রাওয়াতিব এর রাকাত সংখ্যা হছে নিন্মরূপঃ
(১) ফযরের ফরয সালাতের পূর্বে ২ রাকাত।
(২) যোহরের ফরয সালাতের পূর্বে ৪ রাকাত, ফরয সালাতের পরে ২ রাকাত।
(৩) মাগরিবের ফরয সালাতের পরে ২ রাকাত।
(৪) এশার ফরয সালাতের পরে ২ রাকাত।
এই মোট ১২ রাকাত সালাত সুন্নত সালাত পড়ার ফযীলতঃ
মুমিনদের জননী, উম্মে হাবীবাহ রামলা বিনতে আবু সুফিয়ান রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, যে কোনো মুসলিম ব্যক্তি আল্লাহর (সন্তুষ্টি অর্জনের) জন্য প্রতিদিন ফরয সালাত ছাড়া (অতিরিক্ত) বারো রাকআত সুন্নত সালাত পড়ে, আল্লাহ তার জন্য জান্নাতের মধ্যে একটি গৃহ নির্মাণ করেন অথবা তার জন্য জান্নাতে একটি গৃহ নির্মাণ করা হয়।
সহীহ মুসলিমঃ ৭২৮, জামি তিরমিযীঃ ৪১৫, সুনানে নাসায়ীঃ ১৭৯৬, আবু দাউদঃ ১২৫০, ইবনু মাজাহঃ ১১৪১, আহমাদঃ ২৬২৩৫, দারেমীঃ ১২৫০।
কয়েকটি মাসয়ালাঃ
(১) এই ১২ রাকাত সালাত পড়া সুন্নতে মুয়াক্ক্বাদা, ফরয বা ওয়াজিব নয়। তবে এই সালাত পড়ার জন্যে আমাদের যত্নশীল হওয়া উচিৎ, বিনা কারণে অলসতা করা উচিৎ নয়। কারণ, আমাদের অনেকের হয়তো পূর্বে ফরয সালাত ছুটে গেছে, বা বর্তমানে যেই সালাত পড়ছি সেখানে দোষ-ত্রুটি রয়েছে। কিয়ামতের দিন এই ১২ রাকাত সুন্নত সালাত দ্বারা ফরয সালাতের ঘাটতি পূরণ হবে ইন শা আল্লাহ।
আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, কিয়ামতের দিন মানুষের আমলসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম তাদের সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হবে। তিনি বলেন, আমাদের মহান রব্ব ফেরেশতাদেরকে তাঁর বান্দার সালাত সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করবেন, যদিও তিনি নিজেই সে সম্পর্কে অধিক জ্ঞাত আছেন। আল্লাহ বলবেন, তোমরা দেখতো সে ফরয সালাতগুলো পূর্ণরূপে আদায় করেছে, নাকি সেখানে কোন ক্রটি আছে? অতঃপর বান্দার সালাত পরিপূর্ণ হলে তা তদ্রুপই লেখা হবে। আর যদি তাতে কোন ক্রটি-বিচ্যুতি পরিলক্ষিত হয়, তবে তিনি (রব্ব) ফেরেশতাদের বলবেন, দেখতো আমার বান্দার কোন সালাত আছে কি? যদি থাকে তবে তিনি বলবেন, তোমরা তার নফল সালাত দ্বারা তার ফরয সালাতের ঘাটতি পূরণ কর। অতঃপর, এইরূপে সমস্ত ফরয আমলের ক্রটি নফল আমল দ্বারা দূরীভূত করা হবে।
সুনানে আবু দাউদঃ ৮৬৪, তিরমিযীঃ ৪১৩, ইবনে মাজাহঃ ১৪২৫।
হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন ইমাম তিরমিযী, ইমাম হাকেম ও শায়খ আলবানী।
(২) পুরুষদের উচিৎ নফল ও সুন্নাত সালাতগুলো ঘরে পড়ার চেষ্টা করা। নফল সুন্নত সালাত ঘরে পড়লে বেশি সওয়াব, আর এতে করে ঘরে আল্লাহর বরকত নাযিল হয় এবং ঘরের নারী ও সন্তানেরা নামাযের প্রতি, ইসলামের প্রতি আগ্রহী হবে। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
তোমাদের কেউ সলাত পড়লে তার কিছু অংশ সে যেন তার ঘরে পড়ে। কারণ তার সলাতের উসীলায় আল্লাহ তার ঘরে প্রাচুর্য দান করেন।
ইবনে মাজাহ, আহমাদঃ ১০৭২৮, ১১১৭৩। তাহক্বীক্বঃ সহীহ, শায়খ আলবানী, সিলসিলাহ আস-সহীহাহঃ ১৩৯২।
আমরা কি জানি প্রতিদিন সুন্নাত সালাতগুলো মসজিদে পড়ে কত বড় সওয়াব থেকে আমরা ঞ্চিত হচ্ছি? দেখুন রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কি বলেছেন, কোন ব্যক্তির ফরয সালাত ব্যতীত যাবতীয় সালাত আমার মসজিদে আদায় করার চাইতে তা নিজের ঘরে আদায় করা অধিক উত্তম।
সুনানে আবু দাউদ ও সুনানে তিরমিযী, হাদীসটি সহীহ
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন,
সুন্নাত-নফল সালাত নিজ ঘরে আদায় করার মর্যাদা মানুষের সামনে আদায় করার চেয়ে তেমন বেশি, যেমন ফরয সালাত ঘরে একাকী আদায় করার চাইতে মসজিদে আদায় করার মর্যাদা বেশি
মুসান্নাফ ইবনে আবদুর রাজ্জাক, সিলসিলা সহীহঃ ৩১৪৯
(৩) মসজিদে ফযর সালাতের জামাতের পূর্বে সুন্নত সালাত পড়তে না পারলে, ফরযের পরে ওয়াক্ত থাকলে সুন্নত সালাত পড়ে নেওয়া যাবে। আর ওয়াক্ত শেষ হয়ে সূর্য উদয় হওয়া শুরু হলে বেলা উঠার পরে সুন্নত সালাত কাজা পড়ে নেওয়া যাবে।  

(৪) যোহরের ফরয সালাতের পূর্বে ৪ রাকাত সুন্নত সালাত এক সালামে একসাথে ৪ রাকাত অথবা, দুই সালামে ২+২=৪, এই দুইভাবেই পড়া জায়েজ আহে। তবে দুই সালামে ২+২=৪, এইভাবে পড়া উত্তম। মসজিদে যোহর সালাতের জামাতের পূর্বের সুন্নত সালাত পড়তে না পারলে, জামাতের পরে ফরযের পূর্বের ৪ সুন্নত সালাত পড়ে নেওয়া যাবে।