Thursday, September 22, 2016

আউওয়াবিন নামাজ

আউওয়াবিন নামাজ

‘আউওয়াবিন’ আরবি শব্দ। এটি বহুবচন; অর্থ হলো প্রত্যাবর্তনকারীরা। কর্মবাচ্য বা কর্মকারক ও সম্বন্ধ পদ হিসেবে হয় ‘আওয়াবিন’, কর্তাবাচক ও কর্তৃকারক হিসেবে মূল রূপ হলো ‘আউওয়াবুন’। এর একবচন হলো আউওয়াব, যার মানে হলো প্রত্যাবর্তনকারী। যিনি আল্লাহর দিকে বেশি বেশি ফিরে আসেন, গুনাহ থেকে বেশি পরিমাণে তওবা করেন। ‘আউওয়াব’ শব্দটি পবিত্র কোরআনে চারবার এসেছে। ‘আউওয়াব’ শব্দের আরেকটি অর্থ হলো ‘অত্যধিক অনুগত’, যিনি একান্তে গোপনে নির্জনে নিজের পাপ স্মরণ করে তার জন্য তওবা করে আনুগত্য ও ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর দিকে ফিরে যান। ‘আউওয়াব’ শব্দটি ‘মুসাব্বিহ’ বা তাসবিহ পাঠকারী তথা পবিত্রতা বর্ণনাকারী অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কখনো এটি ‘দৃঢ় সংকল্প’ ও ‘অবিচল’ অর্থে ব্যবহার হয়ে থাকে। আবার ‘সন্ধ্যা সমীরণ’ অর্থেও এর ব্যবহার রয়েছে। আরবদের মধ্যে ‘আবাতিশ শামস’ কথাটি ‘গাবাতিশ শামস’ অর্থে ব্যবহৃত হয়; ‘গারাবাতিশ শামস’ মানে সূর্য অস্তমিত হলো বা সূর্য অস্ত গেল।
শরিয়তের পরিভাষায় ‘আউওয়াবিন নামাজ’ হলো মাগরিবের নামাজর পর এশার নামাজের আগে আদায় করা নামাজ। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি মাগরিবের নামাজের পর ছয় রাকাত নামাজ আদায় করবে; এসবের মাঝে কোনো মন্দ কথা না বলে, তার এই নামাজ ১২ বছরের ইবাদতের সমতুল্য গণ্য হবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, যে ব্যক্তি মাগরিবের নামাজের পর ২০ রাকাত নামাজ আদায় করবে, আল্লাহ তাআলা তার জন্য জান্নাতে একটি প্রাসাদ নির্মাণ করবেন। (তিরমিজি, মিশকাত; ১০৩-১০৪; ফয়জুল কালাম, পৃষ্ঠা: ৩২০-৩২১, হাদিস: ৪৪৯-৪৫০)।
‘রাসুলুল্লাহ (সা.) মাগরিবের পর ছয় রাকাত নামাজ পড়তেন এবং তিনি বলেছেন, যে ব্যক্তি মাগরিবের পর ছয় রাকাত নামাজ পড়বে, তার সব গুনাহ ক্ষমা করে দেওয়া হবে; যদি তা সমুদ্রের ফেনার সমপরিমাণও হয়।’ হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) এই নামাজকে আউওয়াবিন নামে অভিহিত করেছেন। ইমাম তীবি (রা.)-এর মতে, মাগরিবের দুই রাকাত সুন্নতও এই ছয় রাকাতের অন্তর্ভুক্ত। অবশিষ্ট রাকাতগুলো এক নিয়তে দুই বা চার রাকাত করে পড়া যায়। মাগরিবের পর সর্বোচ্চ ২০ রাকাত ও সর্বনিম্ন দুই রাকাত পড়ার কথা বর্ণিত আছে; চার রাকাত এবং ছয় রাকাতের বর্ণনাও পাওয়া যায়। যার পক্ষে যখন যা সম্ভব, তিনি তা-ই পড়বেন।

ইশরাকের নামায

ইশরাকের নামাজ

‘ইশরাক’ অর্থ হলো উদয় হওয়া বা আলোকিত হওয়া। শরিয়তের পরিভাষায় ইশরাক হলো সূর্যোদয়ের পর যখন পূর্ণ কিরণ বিচ্ছুরিত হয়, সে সময়। এই সময়ের নামাজকে ইশরাক নামাজ বলা হয়। 

এ নামাজের ওয়াক্ত ফজরের কমপক্ষে ২০ মিনিট পর শুরু হয়ে ২ ঘণ্টা অবধি থাকে। এ নামাজ পড়া মুস্তাহাব। 
নিয়ম হলো ফজরের নামাজের পর জায়নামাজ থেকে না ওঠে তাসবিহ-তাহলিল, দোয়া-দরুদ, জিকির-আযকার ইত্যাদিতে রত থাকা এবং ওয়াক্ত হলেই এ নামাজ পড়ে নেয়া। অবশ্য জায়নামাজ ছেড়ে ওঠে গেলেও এ নামাজ পড়া যায়, তবে সওয়াব আগের মতো হবে না। 
হযরত আলী (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি ফজরের নামাজ আদায় করে স্বীয় স্থানে বসে থাকে, তার জন্য ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। তারা এভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, হে আল্লাহ, তাকে ক্ষমা করুন; হে আল্লাহ, তার প্রতি দয়া করুন। আর যে নামাজের অপেক্ষায় থাকে তার জন্যও ফেরেশতারা ক্ষমা প্রার্থনায় রত থাকেন। তারা এভাবে ক্ষমা প্রার্থনা করেন, হে আল্লাহ, তাকে ক্ষমা করুন; হে আল্লাহ, তার প্রতি দয়া করুন। (মুসনাদে আহমদ)। 

হাদিসে আছে, যে ব্যক্তি ফজরের সালাত জামাতের সঙ্গে আদায় করবে, তারপর সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর জিকিরে রত থাকবে; অতঃপর দুই রাকাত সালাত আদায় করবে, তবে সে একটি হজ ও একটি ওমরাহর সওয়াব লাভ করবে। পরিপূর্ণ! পরিপূর্ণ! পরিপূর্ণ! অর্থাৎ একটি হজ ও একটি ওমরাহর পরিপূর্ণ সওয়াব লাভ করবে। (তিরমিজি: ৫৮৬)। 

হযরত আলী (রা.) এর বর্ণিত অপর এক হাদিসে এসেছে, 'যে ব্যক্তি ফজরের সালাত আদায় করল এবং বসে বসে সূর্যোদয় পর্যন্ত আল্লাহর জিকির করল, অতঃপর দুই রাকাত বা চার রাকাত নামাজ আদায় করল, আগুন তাকে স্পর্শ করবে না। (বায়হাকি)।

হাদিসে কুদসিতে এসেছে, আল্লাহ বলেন, হে আদম সন্তান, দিনের প্রথম ভাগে আমার জন্য চার রাকাত নামাজ নিশ্চিত করো, আমি দিনের শেষভাগে তোমার জন্য যথেষ্ট হয়ে যাব। (মুসনাদে আহমদ, খ- ২, পৃ. ৬১২)।

‘রাসুলুল্লাহ (সা.) ফজরের নামাজের পর সূর্যোদয় পর্যন্ত বসে থাকতেন; এরপর সূর্য ওপরে উঠলে তিনি (ইশরাকের) নামাজ আদায় করতেন।’ (আবু দাউদ: ১২৯৪)।

মুফতি আমিমুল ইহসান (রা.)-এর মতে, সাধারণত সূর্যোদয়ের ২৩ মিনিট পর ইশরাকের ওয়াক্ত শুরু হয়। কারও মতে, সূর্যোদয়ের ২৫ বা ৩০ মিনিট পর থেকে এর সময় আরম্ভ হয়। শায়খ ইসাইমিনের মতে, সূর্যোদয়ের ১৫ মিনিট পর ইশরাক আরম্ভ হয়। আধুনিক গবেষণায় সূর্যোদয়ের পাঁচ থেকে আট মিনিট পরই ইশরাকের সময় হয়। সকাল নয়টা পর্যন্ত এই নামাজ আদায় করা যায়।

Sunday, September 18, 2016

সুদঃ ইন্টারেস্ট বা মুনাফা, ব্যাংকের প্রফিট, শেয়ার, চাকুরী

সুদঃ ইন্টারেস্ট বা মুনাফা, ব্যাংকের প্রফিট, শেয়ার, চাকুরী

সুদ খাওয়া’ কত বড় পাপ?
১. আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ৭টি কবীরাহ গুনাহকে ‘ধ্বংসাত্বক’ বলে সেইগুলোর ব্যপারে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। তার মাঝে ‘সুদ’ একটি।
সহীহ বুখারীঃ ২৭৬৬; সহীহ মুসলিমঃ ৮৯; আবু দাউদ; নাসাঈ।

২. আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
জেনেশুনে মানুষের কাছ থেকে মাত্র ‘এক দিরহাম’ সুদ খাওয়া অপেক্ষা ‘৩৬ বার জিনা করা’ আল্লাহর কাছে অধিক গুরুতর বিষয়।
মুসনাদে আহমদঃ ৫/৩৩৫; ত্বাবারানীর কাবীর ও আউসাত্ব। হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ; সহীহুল জামিঃ ৩৩৭নং হাদীস।

৩. আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আরো বলেছেন,
সুদ খাওয়ার মাঝে রয়েছে ৭০ প্রকার পাপ। এর মাঝে সবচাইতেছোট পাপ’ হচ্ছে নিজের মায়ের সাথে জিনা করার মতো।(নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক)!
ইবনে মাজাহঃ ২২৭৮। হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ; সহীহ ইবনে মাজাহঃ ১৮৪৪।
_________________________
কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যেমন ব্যংক, এনজিও, অর্থ লগ্নিকারী বা ঋণ দানকারী ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি, যারা মানুষদেরকে ঋণ দিয়ে সুদ খায়, আল্লাহ তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেনঃ
উযু বিল্লাহিমিনাশ-শাইতানির রাযীম।
২৭৮. হে ঈমানদারগণ!  তোমরা আল্লাহকে ভয় কর এবং, যদি তোমরা সত্যিই ঈমানদার হয়ে থাক তাহলে বকেয়া সুদের টাকা ছেড়ে দাও।
 ২৭৯. আর তোমরা যদি সুদের টাকা না ছাড়, তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের সাথে যুদ্ধ করার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ কর।
_________________________
কোন ‘সুদখোর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে’ সাহায্য করা বা তাদের অধীনে চাকুরী করা ‘হারাম’ এবং মারাত্মক গুনাহর কাজঃ
১. আল্লাহ তাআলা বলেন,
সৎকর্ম এবং তাক্বওয়া (আল্লাহভীতীর) ব্যপারে তোমরা একজন আরেকজনকে সাহায্য করবে, আর পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে তোমরা একে অন্যকে সাহায্য করবেনা। আর তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয় আল্লাহ তাআলা কঠোর শাস্তিদাতা...।
সুরা আল-মাইয়িদাহঃ ২।

২. আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন,
যে ব্যক্তি সুদ খায় এবং যে সুদ দেয়, যে সুদের কথা লিখে রাখে এবং যারা সুদের সাক্ষী হয়, তাদের সবার উপরে আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম লানত (বা অভিশম্পাত) করেছেন। তিনি আরো বলেছেন, এই সবগুলো মানুষ পাপের দিক থেকে সমান।
সহীহ মুসলিমঃ ১৫৯; মুসনাদে আহমদ, আবু দাঊদ, তিরমিযী, নাসাঈ এবং ইবনে মাযাহ্। ইমাম তিরমিযী (রহঃ) এই হাদীসটিকেসহীহ’ বলেছেন।
_________________________
সুদ এবং ব্যংক সম্পর্কিত কিছু মাসয়ালাঃ
১. কোন সুদখোর ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা ব্যংকের অধীনে চাকুরী করা হারাম। সেটা ম্যানেজার, অফিসার, সুপারভাইজার, দারোয়ান, সিকিউরিটি গার্ড বা পিয়ন, যেকোন পোস্টেই হোক না কেনো। কারো যদি জীবন রক্ষার জন্য অত্যাবশ্যকীয়, এমন জরুরী অবস্থা সৃষ্টি না হলে এমন চাকুরী করা তার জন্যে বৈধ হবেনা। 
২. কোন সুদখোর ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের মালিক, অথবা সুদী প্রতিষ্ঠানে কর্মরত, এমন কোন নারী অথবা পুরুষকে বিয়ে করা জায়েজ নয়। গার্জিয়ানদের জন্যে এমন কারো সাথে মেয়ের বিয়ে দেওয়া জায়েজ নয়।
৩. সুদের টাকা এবং সুদী প্রতিষ্ঠানে কাজের বিনিময়ে অর্জিত উপার্জন হালাল নয়। এইভাবে জমানো টাকা সুদ দাতাকে ফেরত দিতে হবে, বা সওয়াবের নিয়ত ছাড়াই গরীব-মিসকীনকে দিয়ে দিতে হবে।
৪. সুদের উপরে লোন নিয়ে বাড়ি নির্মান করা, গাড়ী বা অন্য কিছু ক্রয় করা, বিয়েতে জাকজমকপূর্ণ অপব্যয় ও বিলাসী কাজ করা, ইত্যাদি কাজগুলো নাজায়েজ, হারাম।
৫. সরকারী অফিসে পেনশনের সাথে যেই টাকা সুদ হিসেবে অতিরিক্ত যোগ হয়, সেটা হারাম। নিজের প্রাপ্য মূল বেতন-ভাতার বাইরে সুদ হিসেবে অতিরিক্ত যেই টাকা আসে, সেটা সওয়াবের নিয়ত ছাড়াই গরীব-মিসকীনকে দিয়ে দিতে হবে।
৬. অনেক নারী ও পুরুষ ফিক্সড ডিপোজিট করে, অথবা ব্যংকে টাকা রেখে ইন্টারেস্ট বা মুনাফা গ্রহণ করে। এই টাকা সুদ, যারা এই মুনাফা ভোগ করে তারা সুদখোর, তারা সুদখোর।
৭. সুদের টাকা দিয়ে ক্রয় করা খাবার খাওয়া হারাম।
৮. ব্যংক বা বীমা প্রতিষ্ঠানের শেয়ার কেনা হারাম।
৯. প্রাইজ বন্ড ক্রয় করা হারাম, এর পুরষ্কার গ্রহণ করা হারাম।
১০. প্রাচীন যুগ থেকে আজ পর্যন্ত ‘ইয়াহুদী জাতির’ লোকেরা সুদ খাওয়ার ব্যপারে সবচাইতে এগিয়ে। 
১১. ইয়াহুদী-খ্রীস্টানরা ড. ইউনুসকে ‘নোবেল পুরষ্কার’ দিয়ে সম্মানিত করতে পারে, কিন্তু আল্লাহর দৃষ্টিতে তিনি মোটেও সম্মানিত বা ভালো কোন মানুষ নন। বরং মনভোলানো সুন্দর সুন্দর কথা বলে তিনি দরিদ্র মানুষের কাছ থেকে সুদের মাধ্যমে ‘জোঁকেরমতো তাদের রক্ত চুষে খাওয়ার একটা ‘অভিশপ্ত ব্যংক’ চালু করেছেন।  
১২. সুদী ব্যংক বা প্রতিষ্ঠান সেটা সরকারী হোক কিংবা বেসরকারী - সবগুলোই হারাম বা নিষিদ্ধ।
১৩. কোন ব্যক্তিকে ‘ধার’ বা ঋণ দিয়ে তার জন্যে কোনআমানত’ বা বন্ধক নিলে, সেই বন্ধকের দ্বারা কোনভাবে লাভবান হওয়া একপ্রকার সুদ।
প্রখ্যাত তাবেয়ী বিদ্বান ইমাম হাসান আল-বসরী রাহিমাহুল্লাহ বলেন,তোমার কাছে ঋণগ্রস্থ এমন ব্যক্তির কাছ থেকে তুমি যদি কিছু খাও, তাহলে সেটা সুদ।
কিতাবুল কাবায়ের, ইমাম আয-যাহাবী রাহিমাহুল্লাহ।
উদাহরণঃ কোন ব্যক্তি কাউকে ২ বছরের জন্যে ২০ হাজার টাকা ধার দিলো, কোন প্রকার সুদের শর্ত ছাড়াই। কিন্তু টাকারজামানত’ বা সিকিউরিটির জন্যে সে ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে এক ভরি স্বর্ণ, একটা গরু বা এক কাঠা জমি ‘আমানত’ বা বন্ধক হিসেবে নিলো। এখন যতদিন পর্যন্ত না সে তার ধারের টাকা ফেরত দিচ্ছে সে যদি সেই স্বর্ণ তার স্ত্রী-কন্যাকে ব্যবহার করতে দেয়, বা সেই গরু দিয়ে হাল চাষ করে বা তাঁর দুধ দোহন করে খায় বা বিক্রি করে, অথবা সেই জমি চাষ করে লাভবান হয়, তাহলে সেটা সুদ হিসেবে গণ্য হবে। সাধারণত গ্রামাঞ্চলে এটা খুব বেশি দেখা যায়। ঋণদাতা যদি এই সুদ থেকে বাঁচতে চায়, তাহলে তাকে স্বর্ণ ব্যবহারের জন্যে বা গরু থেকে লাভবান হওয়ার জন্যে তার মূল্য বা অংশ, জমি চাষের জন্যে তার ‘লীজ মূল্য’ দিতে হবে।
১৩. আরো হয়তোবা অনেক বিষয় বাকি রয়ে গেলো, এই মুহূর্তে মনে পড়ছেনা।
_________________________
যার সুদ এবং সমস্ত হারাম রুজি থেকে বেঁচে থাকতে চান, তারা আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর শেখানো এই দুইটি দুয়া নিয়মিত পড়বেনঃ
ক. ছোট্ট, কিন্তু খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা দুয়াঃ

اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ عِلْماً نافِعاً، وَرِزْقاً طَيِّباً، وَعَمَلاً مُتَقَبَّلاً

উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মা ইন্নী আস-আলুকা ইলমান নাফিআন, ওয়া রিযক্বান ত্বাইয়্যিবান, ওয়া আমালান মুতাক্বাববালান।
অর্থঃ হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট উপকারী জ্ঞান, পবিত্র জীবিকা ও গ্রহণযোগ্য আমল প্রার্থনা করছি। ইবনে মাজাহ, হিসনুল মুসলিম পৃষ্ঠা ১১৩।
প্রতিদিন ফযরের ফরয সালাত শেষে এই দুয়া একবার করে পড়া সুন্নাহ।
খ. ঋণের বোঝা এবং হারাম উপার্জন থেকে বাঁচার জন্যে দুয়াঃ

اللَّهُمَّ اكْفِنِي بِحَلاَلِكَ عَنْ حَرَامِكَ، وَأَغْنِنِي بِفَضْلِكِ عَمَّنْ سِوَاكَ

উচ্চারণঃ আল্লা-হুম্মাকফিনী বিহালা-লিকা আন হারা-মিকা ওয়া আগনিনী বিফাযলিকা আম্মান সিওয়া-ক।
অর্থঃ হে আল্লাহ! আপনি আমাকে আপনার হালাল বস্তু দ্বারা সন্তুষ্ট করে আপনার হারাম বস্তু থেকে ফিরিয়ে রাখুন। আর আপনার অনুগ্রহ দ্বারা আপনি ছাড়া অন্য সকলের কাছ থেকে আমাকে অমুখাপেক্ষী রাখুন।
তিরমিযীঃ ৩৫৬৩। হাসান সহীহ, শায়খ আলবানী।
_________________________
মুসলিমদের মাঝে যারা সামর্থ্যবান তাদের দায়িত্ব হচ্ছে যাকাত, উশর, দান-সাদাকা, কর্জে হাসানাহ ইত্যাদি শরিয়াহ নির্দেশিত কাজের মাধ্যমে অন্য মুসলিম ভাইদেরকে সাহায্য করা এবং মুসলিম সমাজ থেকে সুদের মতো অভিশাপকে উৎখাত করার জন্যে সাধ্য অনুযায়ী জিহাদ করা।
_________________________
আল্লাহ আমাদেরকে সেই তোওফিক দান করুন, এবং আমাদের আমাদের পরিবারেকে সুদ এবং যাবতীয় হারাম কাজ থেকে বেঁচে থাকতে সাহায্য করুন। (আমিন)


কবরে ৩টি প্রশ্ন ও হাশরের ময়দানে ৫টি প্রশ্ন

কবরে ৩টি প্রশ্ন ও হাশরের ময়দানে ৫টি প্রশ্ন

(ক) কবরে ৩টি প্রশ্ন করা হবেঃ
১. তোমার রব্ব কে?
২. তোমার দ্বীন কি?
৩. রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর ব্যপারে প্রশ্ন করা হবে, তিনি কে বা তুমি কি তাঁকে নবী হিসেবে বিশ্বাস করেছিলা?
সুনানে আবু দাউদঃ ৪৭৫৩, হাদীসটি সহীহ, শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ।

(খ) হাশরের ময়দানে ৫টি প্রশ্ন করা হবেঃ
আবু বারযা নাদলা ইবনে উবায়েদ আসলামী রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
কিয়ামতের দিন (হাশরের ময়দানে) বান্দা তার স্থানেই দাঁড়িয়ে থাকবে,
যে পর্যন্ত না তাকে জিজ্ঞেস করা হবেঃ
১. তার জীবনকাল কিভাবে কাটিয়েছে,
২. তার জ্ঞান কি কাজে লাগিয়েছে,
৩. তার সম্পদ কোথা থেকে অর্জন করেছে,
৪. তার সম্পদ কোথায় খরচ করেছে এবং
৫. তার শরীর কিভাবে পুরানো করেছে?


সুনানে আত-তিরমিযীঃ ২৪১৭, হাদীসটি হাসান ও সহীহ, শায়খ আলবানী রাহিমাহুল্লাহ। 

তেলাওয়াতের সেজদাহ ও সেজদার আয়াত

তেলাওয়াতের সেজদাহ ও সেজদার আয়াত

বিসমিল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ। ওয়াস সালাতু ওয়াস সালামু আলা রাসুলিল্লাহ।

(১) সেজদার আয়াত কি?

কুরআনুল কারীমে এমন কিছু আয়াত আছে, যেইগুলো পড়লে বা শুনলে সেজদাহ করতে হয়, এই আয়াতগুলোকে সেজদার আয়াত বলা হয়। সাধারণত, এই আয়াতগুলোতে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে সরাসরি সেজদাহ করার জন্য আদেশ করেছেন, অথবা কখনো উৎসাহিত করেছেন সেজদাহ করার জন্য। এজন্যে এই আয়াতগুলো পড়লে, আয়াতের হক্ক হিসেবে, আল্লাহর আদেশ পালনের জন্যে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম একটা সেজদাহ করতেন। আমরা আমাদের প্রিয়নবীর অনুসারী হিসেবে সেই সুন্নতের অনুসরণ করি। সাধারণত কুরআনে বিভিন্ন চিহ্ন ও কথার দ্বারা স্পষ্ট বলা থাকে, এটা সেজদার আয়াত।

(২) কুরআনে সেজদার আয়াত কয়টি ও কি কি?

এ ব্যপারে আলেমদের মাঝে কিছুটা ইখতিলাফ বা মতবিরোধ হয়েছে। তবে অনেক আলেম কুরআনে মোট ১৫টি সেজদার আয়াত রয়েছে বলে একমত পোষণ করেছেন। আর সেই আয়াতগুলো হচ্ছেঃ
সুরা আরাফঃ ২০৫, সুরা রাদঃ ১৫, সুরা নাহলঃ ৪৯, সুরা বনী ইসরাঈলঃ ১০৭,  সুরা মারিয়ামঃ ৫৮, সুরা হাজ্জঃ ১৮, সুরা হাজ্জঃ ৭৭, সুরা ফুরক্বানঃ ৬০, সুরা নমলঃ ২৫, সুরা সাজদাহঃ ১৫, সুরা ছোয়াদঃ ২৪, সুরা হা মীম সাজদাহঃ ৩৭, সুরা নজমঃ ৬২, সুরা ইনশিক্বাকঃ ২১, সুরা আলাক্বঃ ১৯।

(৩) সেজদার আয়াত পড়লে বা শুনলে সেজদাহ দেওয়ার হুকুম কি?

আল্লামাহ আব্দুল আজিজ বিন বাজ রাহিমাহুল্লাহ বলেন, নামাযের ভেতরে কিংবা বাইরে, সেজদাহর আয়াত পড়লে বা শুনলে একটা সেজদাহ দেওয়া সুন্নত, ফরয কিংবা ওয়াজিব নয়। মাজমু ফাতওয়া ওয়া মাক্বালাত সামাহাত আল-শায়খ ইবনে বাজ, ১১/৪০৬। 
আল্লামাহ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসায়মিন রাহিমাহুল্লাহ বলেন,সেজদাহর আয়াত পড়লে বা শুনলে তার জন্যে একটা সেজদাহ দেওয়া সুন্নত, ফরয কিংবা ওয়াজিব নয়। মাজমু আল-ফাতওয়াঃ ১৪/৩১৮।

(৪) তেলাওয়াতের সেজদাহ কিভাবে করতে হয়?

নামযের ভেতরে কিংবা বাইরে সেজদার আয়াত পড়া বা শোনার পরতাকবীর দিয়ে (অর্থাৎ, আল্লাহু আকবার) বলে সরাসরি সেজদাতে চলেযেতে হবে। সেজদাতে যাওয়ার পর স্বাভাবিক নামাজের সেজদার মতোইসুবহানা রাব্বীয়্যাল আলা তাসবীহ পড়তে হবে। এরপরে কেউ যদি অন্যান্য সেজদার তাসবীহ পড়তে চায়, পড়তে পারবে। যেকোন সেজদাতে অন্তত সুবহানা রাব্বীয়্যাল আলা এই তাসবীহ পড়া ওয়াজিব। এর অতিরিক্ত অন্য তাসবীহগুলো (যেমন- সুবহানাকা আল্লাহুম্মা রাব্বানা ওয়াবি হামদিকাআল্লাহুম্মাগ ফিরলী) পড়া সুন্নত বা মুস্তাহাব। উল্লেখ্য, তেলাওয়াতের সেজদাহর জন্যে বিশেষ একটা দুয়া আছে, সেই দুয়াটা মুখস্থ থাকলে সেটা পড়া আরো ভালো। আপনারা সেই দুয়াটা মুখস্থ করতে চাইলে হিসনুল মুসলিম বই থেকে দেখে নিন। তাসবীহ পড়া শেষ হলে, একটা মাত্র সেজদাহ দিয়েই দাঁড়িয়ে যেতে হবে। কারণ, তেলাওয়াতের সেজদার জন্যে সেজদা করতে হয় মাত্র একটা, দুটো নয়। উল্লেখ্য, যদি নামাযের মধ্যে হয় তাহলে আল্লাহু আকবার তাকবীর দিয়ে দাঁড়াতে হবে। আর যদি নামাযের বাইরে হয় তাহলে একটা সেজদাহ দিয়ে দাঁড়িয়ে যাবে, আল্লাহু আকবর বলতে হবেনা বা সালাম ফেরাতে হবেনা। এহচ্ছে তেলাওয়াতের সেজদার সুন্নতী পদ্ধতি।

(৫) তেলাওয়াতের সেজদাহ করার কি ফযীলত?

রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, আদম সন্তান যখন কোন সেজদার আয়াত পড়ে অতঃপর সেজদাহ করে, তখন শয়তান তার কাছ থেকে কাঁদতে কাঁদতে চলে যায় আর বলেঃ হায় আফসোস, আমার কি দুর্ভাগ্য! আদম সন্তানকে সেজদাহ করতে আদেশ করা হয়েছে, আর সে সেজদাহ করেছে। একারণে তাকে জান্নাত দেওয়া হবে। আর আমাকে সেজদাহ করতে আদেশ করা হয়েছিলো, কিন্তু আমি সেই আদেশ অমান্য করেছিলাম। একারণে আমি জাহান্নামে যাবো। সহীহ মুসলিম, মুসনাদে আহমাদ, ইবনে মাজাহ।

(৬) সুরা মুখস্থ করার সময় সেজদার আয়াত বারবার পড়লে কয়টা সেজদাহ দিতে হয়?

আল্লামাহ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসায়মিন রাহিমাহুল্লাহ বলেনকেউ যদি মুখস্থ করার জন্যে একই সেজদার আয়াত বারবার পড়ে, তাহলে প্রথম একবার পড়ার পরে একটা সেজদাহ দিলেই হবে। এরপরে সে যখন একই সেজদার আয়াত পুনরায় পড়বে, তখন আবার সেজদাহ না দিলেও হবে।মাজমু আল-ফাতওয়াঃ ১৪/৩১৮।

(৭) তেলাওয়াতের সিজদার জন্য ওযু থাকা ফরয কি না?

এ ব্যাপারে আলেমদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন, ওযু থাকতেই হবে। কোন কোন আলেম বলেছেন তেলাওয়াতের সিজদারজন্যে ওযু থাকা ফরয নয়, ওযু ছাড়াও তেলাওয়াতের সিজদাহ করা যাবেকারণ, আব্দুল্লাহ বনে মার রাদিয়াল্লাহু আনহু ওযু ছাড়াই তেলাওয়াতেরসেজদা করতেন।  এখান থেকে অনেক আলেম দলিল নিয়েছেন, যেহেতু তেলাওয়াতের সিজদা কোন নামায নয়, একটা সেজদাহ, আর কুরআন বা হাদীসে কোথাও তেলাওয়াতের সিজদার জন্যে ওযু থাকতেই হবে, একথা উল্লেখ নেই, তাই ওযু সহ কিংবা ওযু ছাড়া, সর্বাবস্থাতেই তেলাওয়াতের সিজদাহ করা যাবে। মাজমু ফাতওয়া ওয়া মাক্বালাত সামাহাত আল-শায়খ ইবনে বাজ, ১১/৪০৬। 

(৮) মোবাইল, কম্পিউটার কিংবা অডিও ভিডিও রেকর্ডিং থেকে কুরআন তেলাওয়াত শোনার সময় কি তেলাওয়াতের সিজদাহ করতে হবে?

নাহ, করতে হবেনা। অনেক আলেমের মতে, রেকর্ডিং থেকে কুরআন তেলাওয়াত শোনার সময় তেলাওয়াতের সিজদাহ করার প্রয়োজন নেই। 

শায়খ আব্দুল আজিজ বিন বাজঃ মাজমু ফাতওয়া শায়খ ইবনে বাজ ১১/৪১৫; মুহাম্মদ বিন সালেহ আল-উসায়মিনঃ আল-শরাহ আল-মুমতি ৪/১৩৩।